সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি ক্রিমিয়া উপদ্বীপ যা বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী ইউক্রেনের একটি শ্বায়ত্বশাসিত রাজ্য মাত্র, একসময় তা ছিল মুসলিম বিশ্বের স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। এখানে বাস করতেন সেইসব তাতারি মুসলমান, যারা নিজেদের সামর্থের শেষ বিন্দুটুকুও খরচ করতেন ইসলামের প্রতিরক্ষায়। ইসলামের প্রচার-প্রসার আর ইলমের প্রাণকেন্দ্র বানিয়ে নিয়েছিলেন যারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে। যাদের মধ্যে জন্মেছিলেন এমন কতেক সোনার ছেলে যাদেরকে ইতিহাস আজীবন স্মরণ করবে নিজ গরজে।
তাদের ভাষা ছিল তাতারি। এটি ছিল তুর্কিভাষার অন্যতম একটি উপভাষা। এখানকার অধিবাসীরা একপর্যায়ে ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন রাশিয়ার বিপুল বিস্তার জমিনে, ইউরাল পর্বতশ্রেণির পাদদেশীয় অঞ্চলে এবং প্রলম্বিত ভলগা নদীর কিনারে কিনারে। একসময় এ নদীর উৎস থেকে নিয়ে মোহনা পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড এসেছিল মুসলিম তাতারিদের অধীনে। সেদিন ক্রিমিয় খানদেরকে কর দিয়ে এবং তাদের তাবেদারী করে চলতো মস্কোর ‘জার’-রা। এরপর যখন ওদের দুর্দিন ঘনিয়ে এলা তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো সেই পরাজিতশক্তি। এবং দীর্ঘ দিন চলতে থাকলো সীমান্ত সংঘর্ষ।
পরবর্তীতে তাতারিদের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা তথা সালতানাতে উসমানিয়া দুর্বল হয়ে এলে ক্রিমিয়দের মোকাবেলা করতে হলো রুশ শ্বেতভল্লুকদের হিংস্রকুঠিল ষড়যন্ত্র আর আধিপত্যবাদের নির্মম নির্যাতন এবং দুর্ভাগ্যের চরম মুহূর্তে তাদেরকে নির্বাসিত হতে হয় অন্যত্রের মুসলমানদের মতো সাইবেরিয়ার বরফঢাকা প্রান্তরে। তাদের ফেলে যাওয়া ভূখণ্ডে চলে অর্থোডক্স খিস্টদৈত্যদের তাণ্ডবলীলা। ফলে শিল্পচর্চার মাধ্যমে যে ক্রিমিয়া এক সময় হয়ে উঠেছিল বিশ্বের নয়নাভিরাম অঞ্চল, অধিপত্যবাদী রুশদের ধ্বংসযজ্ঞের ফলে তা হয়ে যায় এক বিরান বধ্যভূমি। এরা মসজিদ, মাদ্রাসা,সরকারি-আধা-সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ সহ ইসলামি ঐতিহ্যমণ্ডিত কোনো স্থাপনাই এখানে আস্ত রাখেনি। সেই হতাশাজনক ইতিহাস আজও হাহাকার-মাখা ভাষায় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে রক্তের আখরে।

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি:

বিশ্বস্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি এই ভূখণ্ডটি ইউক্রেনের দক্ষিণনাঞ্চলে অবস্থিত। এর পশ্চিমে রয়েছে কৃষ্ণসাগর, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর। আয়তন প্রায় ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। রাজধানী ‘সিমফারোপল’। অধিপত্যবাদী রুশরা দেশটি দখল করে নেয়ার পরই রাজধানীশহরটিকে এ নামে নামকরণ করেছিল। নতুবা ইতোপূর্বে এর নাম ছিল ‘আক মসজিদ’। তাতারি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে ‘সফেদ মসজিদ’। অধিবাসীদের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় আড়াই মিলিয়ন। এদের মধ্যে রুশ ৫৮%, ইউক্রেনীয় ২৪%, অবশিষ্টরা তাতারি মুসলমান। এরাই মূলত এ মাটির প্রকৃত সন্তান।
রাশিয়ার হাতে বিধ্বস্ত হবার পর জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং প্রায় শতাব্দীকাল হিংসাত্মক রাজনীতির শিকার হবার ফলে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি আজ সংখ্যালঘু একটা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে গেছে। রুশরা এদেরকে তাদের আবাসভূমিতে মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করতে দেয় নি। বরং বিভিন্ন অজুহাতে বার বার এসব স্থাপনায় হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তাদের অবস্থা ছিল ঠিক আজকের ফিলিস্তিন, বসনিয়া, চেচনিয়া ও রাশিয়ার অধীন সাবেক তুর্কিস্তানের এলাকাগুলির মতো।

তাতারিদের মধ্যে ইসলামের অনুপ্রবেশের ইতিহাস:

তাতারিদের ইসলামগ্রহণের ইতিহাস হচ্ছে ওদের হাতে মুসলিম উম্মাহর গর্ব বাগদাদের খেলাফতব্যবস্থা ধ্বংস হবার পর পর থেকে। এদের হাতে মুসলিম উম্মাহর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষ পর্যন্ত কুদরত এদেরকেই ইসলামের সুরক্ষার জন্য মজবুত একটা বর্মরূপে গড়ে নেন। এ যেন ‘ভূতখানা থেকে বেরিয়ে আসে ক’াবার প্রহরী’ কথার স্বার্থক বাস্তবায়ন। ৭৪০ হিজরির দিকে এদের একটি গোত্র প্রথম ইসলামের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এই গোত্রের প্রধান-পুরুষ ছিলেন সভ্যতার ত্রাস চেঙ্গিসখানের দৌহিত্র ‘বতুখান’। এদের প্রচেষ্টায় ইউরাল পর্বতমালার পাদদেশীয় বিস্তর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম। আর ‘ফুলজা’ নদীর উৎস থেকে নিয়ে মোহনা পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠেছিল মোঙ্গলদের স্বপ্নরাজ্য স্বাধীন ককেশাস।

তিন শতাব্দী ধরে ইসলামের খেদমত:

ক্রিমিয় উপদ্বীপ; যাকে তাতাররা নিজেদের আবাসভূমি বানিয়ে নিয়েছিল তা হয়ে উঠেছিল বিপুল ঐশ্চর্যমণ্ডিত ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পীটস্থান। সোভিয়ত ইউনিয়ন গঠিত হবার পর যে বিশাল একটি রাষ্ট্র বিশ্ব-মাণচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিল এর বেশিরভাগই ছিল তাতারিদের শাসনাধীন অঞ্চল। ওখানে তাতারিরা শাসন চালিয়েছিল তিন তিনটি শতাব্দীব্যাপী। সেই বিশাল স্বাধীন তাতারিস্তানের মাঝখানে ‘মস্কো’ ছিল এক অসহায় অনাত্মীয়ের মতো। সেদিন মস্কোবাসীরা ককেসীয় আমীরদের মন যোগিয়ে চলতেন। ওদের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নিজেদেরকে ধন্য মনে করতেন। তখন মস্কোর সরকার উঠ-বস করতো তাতারি আমীরদের ইঙ্গিত ইশারায়। ৯১৮ হিজরি পর্যন্ত মস্কো তাতারি আমীরদের কর দিয়ে আশ্রিতরাষ্ট্রের মর্যাদা নিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ইতিহাসের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় ‘আলহাজ দৌলত খায়েরি ইউক্রেনি’ ১৪২৮ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার মসনদে আসীন হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তদীয় দ্বিতীয় ছেলেকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যান। কিন্তু তার ছয় নং ভাই ‘মুনজিল’ তাকে হত্যা করত শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। এরপর উনি ১৪৬৬/১৫১৫ খিস্টাব্দ অবধি ক্রিমিয়া শাসন করেন। ইতিহাসের প্রতি আরেকটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রায় সেকাল থেকেই দুর্বলতা শুরু হয়েছিল তুর্কি খেলাফতব্যবস্থায়।

ক্রিমিয়ার অধোগতি:

রুশরা অব্যাহতভাবে ক্রিমিয়দের সাথে সংঘাত চালিয়ে আসছিল। অবশেষে ১০৯১ হিজরি মোতাবেক ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এক দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্তে ক্রিমীয় উপদ্বীপের একখণ্ড ভূমি দখল করে নিতে সক্ষম হয়ে যায়। আর এ দখলপ্রক্রিয়া ছিল ঠিক সে সময়, যখন অটোমান খেলাফতের সৌভাগ্য-রবি ছিল অস্তগামী। উসমানীয় খলিফারা তাতারিদের সাথে রুশ আক্রমণ ঠেকানোর চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলেও সে দিন তারা তাতারিদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন নি। আসল কথা হলো আসননি নয়, বরং আসতে পারেননি।
তুর্কিদের খেলাফতব্যবস্থা দুর্বল হবার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বমুসলিমের অবস্থা দিন দিন কাহিল থেকে কাহিলতর হচ্ছিল, আর এর বিপরীতে রুশরা হচ্ছিল ক্রমশই সবল। তুর্কিদের মধ্যে যেসব কারণে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল তার অন্যতম কারণ ছিল—সুলতানদের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়া এবং ত্যাগের উপর ভোগের প্রাধান্য প্রদান। এই ভোগকে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই তাদের হেরেমে প্রবেশ ঘটেছিল অমুসলিম ললনাদের। আর এরাই ঘুনপোকার ন্যায় কুড়ে কুড়ে খেয়ে বিশাল সালতানাতে উসমানিয়াকে করে ফেলেছিল সারহীন একটা খোলসে। ঠিক যখন ক্রিমিয়া রুশদের পদানত হয় তখন খেলাফতের আসনে সমাসীন ছিলেন “সুলতান সুলায়মান আল কানুনী”। তিনি উপপত্নী স্বরূপ বেঁচে নিয়েছিলেন রুশ নারী “ব্রকসালানা”কে। আর এই ব্রুকসালানার পরামর্শেই খলিফা রুশদের মোকাবেলায় অস্ত্রধারণে ক্রিমিয়দের নিষেধ করার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। এর ফলাফল কী দাঁড়িয়েছিল? অস্ত্রধারী রুশদের মুকাবেলায় অস্ত্রহীন তাতাররা ঠিকতে পারে নি! আর ক্রিমিয়া ও তার স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় নি!
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার পতন চূড়ান্তপর্যায়ে উপনীত হয়। ঐদিন ক্রিমিয়াকে খেলাফতের অধীনমুক্ত একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা প্রদান করা হয়। এরপর সাম্রাজ্যবাদী রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন ২য় তার চিরাচরিত অভ্যাসানুযায়ী ক্রিমিয়ার সাথে কৃত ওয়াদার পাশাপাশি তুর্কিদের সাথে কৃত ওয়াদাও ভঙ্গ করত ক্রিমিয়ার স্বাধীনতাকে গলাধঃকরণ করে ফেলেন। আর ১৮ এপ্রিল ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ১১৯৮ হিজরি সনে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেন। সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন ২য় ছিল উগ্র খ্রিস্টবাদী এবং প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী। ফলে মুসলমানদের স্বত্তার ন্যায় তাদের ধর্মের উপরও নেেেম এসেছিল এক ভয়াবহ দুর্যোগ।

সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ:

তাতারিরা ছিল স্বভাবস্বাধীন একটা জাতি। কারো অধীনতা তাদের ধাতে ছিল না। তাই নিরস্ত্র হলেও তারা নিজেদের অস্তিত্ব এবং রাষ্ট্র ও ধর্মীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরাক্রমশালী রাশিয়ার মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে যায়। তাদের সেই মুকাবেলা ছিল মরণকামড়ের মতো অত্যন্ত কঠিন। সাম্রাজ্যবাদীদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এই প্রচণ্ড প্রতিরোধের পর ২২ জুন ১৭৯১ সালে সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন ২য় কর্তৃক লেখা প্রকাশিত গ্রন্থে দ্ব্যার্থহীনভাবে এ কথা স্বীকার করে নেয়া হয় যে, রুশদের পক্ষে আমেরিকা আর সাইবেরিয়ায় যাওয়া যতখানি সহজ, ততোখানি কঠিন হচ্ছে ককেশাসে অনুপ্রবেশ।
আধিপত্য স্থাপনের পরও রাশিয়া মুসলমানদের উপর নতুন নতুন অত্যাচার আর নির্যাতনের কৌশল অব্যাহত রেখেছিল। তাদের সেই অত্যাচারের শিকার হয়ে লক্ষাধিক ক্রিমীয় মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। তাদের সেই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ছিল এমনই মানবতাবিরোধী যে, এই বিপুলসংখ্যক নিহতদের দাফন করার মতো কোনো মুসলমান পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে হতভাগা নিহত ঐ লোকগুলোর গলিত লাশের গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠেছিল। আর এরফলে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাপক আকারের মহামরী। ইউক্রেনীয় ও রুশ নরপশুদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আত্মরক্ষার তাগিধে অসংখ্য তাতারি মুসলমান সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী তুরস্কে। এর ফলেই আজ তুরস্কে প্রায় ৫ মিলিয়ন তাতারি মুসলমানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
রুশরা কেবল তাতারিদের রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থার উপর আক্রমণ চালিয়েই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তারা তাতারিদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের উপরও চালিয়েছিল নগ্ন আগ্রাসন। এই বর্বর শ্বেভল্লুকের দল সে-দিন ককেশাসের কোনো মাদ্রাসা-মসজিদ এবং কোনো খানকাহর অস্তিত্ব রাখেনি। তাতারিদের মূল্যবান ইলমি যখিরা তথা লাইব্রেরীগুলো—যা কখনো অর্থমূল্যে পরিমাপ করার নয়, নির্বিচারে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলেছিল। তাতারিরা তখন তাদের ইতিহাসের একটি ভীষণ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। জালেম রুশরা তাদের উপর বিধি-নিষেধের পাহাড় চাপিয়ে রেখেছিল। ফলে ইসলামের চর্চা তথা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
জোরপূর্বক নির্বাসনের ফলে কিছু দিনের ব্যবধানেই ক্রিমিয় মুসলমানগণ রুশ আর ইউক্রেনিয়দের তুলনায় সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হয়ে যায়। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রে জানা যায়—যখন ক্রিমিয়ায় রুশ আর ইউক্রেনীয়দের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন নির্বাসনদ-প্রাপ্ত তাতারিদের যে জমি-জমা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাতে রুশ আর ইউক্রেনীয়দের প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে এরা ঠিকানা এবং আশ্রয়হীন জাতিতে পরিণত হতে বাধ্য হয়ে যায়।

কমিউনিস্টদের ধোঁকা:

১৯১৭ সালে যখন কমউিনিজমবাদীদের বিপ্লব সাধিত হয় তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অন্যান্য মুসলিম জাতির মতো তাতারিরাও ওদের শিকারে পরিণত হয়। কেননা জারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিপ্লবোত্তরকালে শ্বায়ত্বশাসনের ওয়াদা দিয়ে মুসলমানদের সহায়তা নিয়েছিল কমিউনিস্টরা। কিন্তু মুসলমানদের সহায়তা পুরোমাত্রায় গ্রহণ করার পরও বিপ্লবোত্তরকালে তারা তাদের অঙ্গীকারে অটল থাকেনি। উপরন্তু তখন তাদের কুৎসিত চেহারা থেকে সাধুতার মুখোশ খুলে পড়ে তাদের কদাকার চেহারা একেবারে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্টদের এই গাদ্দরী মধ্যএশীয় মুসলমানদের মতো তাতারি মুসলমানদের সাথে সমানভাবেই কার্যকরী ছিল।
জারদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হাবর পর যখন রাজধানী মস্কোতে বিপ্লবীদের ঝাণ্ডা উড্ডীন হয়, তখন ইতোপূর্বের কৃত ওয়াদার পরিপেক্ষিতে তাতারি মুসলমানরাও ক্রিমিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। কিন্তু কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা খুব তাড়তাড়ি রূপ পাল্টে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তাদের স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেয়। তাদের ঐ নির্মমতার কারণে সেদিনও অনেক তাতারিকে শাহাদত বরণ করতে হয়।
এরপর তাতারিদের ঐক্যের সেতু ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে বলশেভিক বিপ্লবীরা ১৮ অক্টোবর ১৯২১ সালে ক্রিমিয়াকে গণপ্রজাতন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য হিসেবে ঘোষণা করত কিছুসংখ্যক বাঁছাইকৃত লোককে রাষ্ট্রপরিচালনার পদে আসীন করে নেয়। তবে এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। লোকদেখানো এই আনুষ্ঠানিকতার অল্পদিন পরই সেই পদগুলি কেড়ে নিয়ে সেই জারদের মতোই গোলামির নিগড়ে বন্দি করে নেয়। মুসলমানদের সাথে কমিউনিস্টদের আচরণ জারদের চেয়ে মোটেও ভালো ছিল না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে এরা জারদের নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। জমিজমা বাজেয়াপ্ত করণ এবং কৃষিকাজে বাধা দানের ফলে ১৯২১-২৩ ব্যাপী যে মন্বন্তর দেখা দিয়েছিল, সে সুযোগে কমিউনিস্টরা মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন‎ করে ফেলার লক্ষ্যে নির্লজ্জ খাদ্যনীতি নামক প্রহসন শুরু করে দেয়। ভাতে মারার উদ্দেশ্যে তুর্কিকর্তৃক যে যৎসামান্য ত্রাণ তাতারিদের জন্য প্রদান করা হতো তা-ও তাতারিদের না দিয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিলি-বন্ঠন করে দিত। ফলে এই অকালে ১৫০ হাজারেরও অধিক ক্রিমীয় মুসলমান মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

তাতারিদের জায়গায় ইহুদিদের আবাসন:

১৯২৩ সালে জোসেফ স্টালিন ক্রিমিয়ায় ইহুদিদের আবাসনের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করে তখন তাতারিরা মসজিদের ইমাম এবং সুশীল নেতৃবৃন্দের পথ নির্দেশনায় এ উদ্দ্যোগের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদী স্টালিন ততোধিত শক্তহাতে সে প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে মুসলিম তাতারিদের সাইবেরিয়ার হীম-শীতল ভূখণ্ডে নির্বাসনে পাঠায়, আর তাদের পৈতৃক বাস্তুভিটায় ইহুদিদের এনে আবাসিত করে। ক্রিমিয়ায় ইহুদিদের আবাসনের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ইহুদিবাদীদের নেতৃবৃন্দ একটি সমাবেশের আয়োজন করে। সে সমাবেশ থেকে তারা স্টালিনের ভূঁয়সী প্রশংসা করেন এবং ফ্যাসিবাদী স্টালিনকে সর্বত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাবার ঘোষণা দেয়।
স্টালিনের উদ্দেশ্য ছিল ক্রিমিয়ায় ইহুদিদের আবাসনের মাধ্যমে তারা ইহুদিজাতির সাথে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে এবং ইহুদিদের মাধ্যমেই বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করবে। (যেমন বর্ণিত হয়েছে রুমান ব্রুকমান রচিত ‘আল-মুলিফ্ফুস্সারী লী জোসেফ স্টালিন’ গ্রন্থে) কিন্তু ইতোমধ্যে বৃটেনের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইউরোপীয় ইহুদিরা ব্যাপকহারে ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করতে থাকলে ওখানকার ইহুদিরাও জাতিবোধের টানে স্টালিনকে এড়িয়ে পাশ্চাত্যের সাথে গাটছাড়া বাধা শুরু করে দেয়। এতো কিছু করার পরও ইহুদিদের এবংবিধ আচরণ তথা শত্রুরাষ্ট্র আমেরিকা আর বৃটেনের সাথে এদের মাখামাখি স্টালিনকে মারাত্মক রকম তাঁতিয়ে তুলে। ফলে সে তাদেরকে নির্মূল করণের অভিপ্রায়ে মেতে ওঠে। এ পর্যায়ে স্টালিন বিপুলসংখ্যক ইহুদি নেতৃবৃন্দকে সাইবেরিয়ার বন্দিশিবিরে চালান করে। স্টালিন তার এ নির্মমতার পেছনে তখন বড় গলায় একথা প্রচার করে বেড়াচ্ছিল যে, আমি এদেরকে ক্রিমিয়ায় আবাসিত করছিলাম, কিন্তু ওরা ক্রিমিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটা স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র বানানোর চক্রান্তে মেতে উঠেছে। ঘটনা দ্রুত পাল্টে যাবার পর স্টালিনের ইচ্ছা জেগেছিল সে আরব মুসলমানদের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করবে। কিন্তু বার বার দাগা খাওয়া আরবরা স্টালিনকে বিশ্বাস করতে না পারায় এ দিকে দিয়েও সে মার খেয়েছিল। যদিও ভূ রাজনিৈতক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আরো আগেই সোভিয়েত ইনিয়নকর্তৃক আরবদের বন্ধুত্ব এবং আস্থা অর্জন উচিৎ ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষের কারণে তারা এ ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। এরপর যখন চেষ্টা করা হলো তখন কোনোই ফল হলো না। কেননা আরবরা তাদের তাতার মুসলিম ভাইদের যুগ যুগ ধরে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হওয়ার দরুণ এমনিতেই ছিল ওদের উপর ক্ষেপা। ফলে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চিমাবিশ্ব তথা আমেরিকা এবং বৃটেন তাদের এক ডানার নিচে ইহুদিদেরকে এবং অপর ডানার নিচে আরব মুসলমানদের নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। আর অল্পদিনের ভেতরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার এটা ও ছিল উল্লেখযোগ্য একটা কারণ।

বেদনাদায়ক নির্মূলকরণ:

স্টালিন রাশিয়ার একেবারে পূর্বাঞ্চলীয় শহর ‘এফ্রিসকিয়ায়’ ইহুদিদের শ্বায়ত্বশাসিত রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। আজ অবিধি সেটি এভাবেই আছে। রুশরা এখনও এটিকে “ইহুদি এলাকা” নামেই ডেকে থাকে। ইহুদিদের উপর বিপর্যয় চলাকালে রাশিয়ার সকল ইহুদিরা সেখানে চলে গিয়েছিল। আরবদের পক্ষ থেকে নিরাশ হবার জ্বালা মেটানোর জন্য স্টালিন নানা ছল খুঁজছিল। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তাতারিরা জার্মানির ‘নাজি’ বাহিনীকে সহায়তা যুগিয়েছে এই অভিযোগ এনে পুনরায় তাদের উপর হামলে পড়ে এবং অবশিষ্ট তাতারিদেরকে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে উজবেকিস্তান এবং সাইবেরিয়ায় নির্বাসনের হুকুম জারি করে। ১৯৪৪ সালের ১৮ ই আগস্ট স্টালিন এই নির্বাসনের ঘোষণা জারি করেছিল। সেই নির্বাসন এবং উচ্ছেদ অভিযান ছিল ইতোপূর্বের সকল নির্বাসন এবং উচ্ছেদ অভিযানের চেয়ে ব্যাপক। আর সেটা ছিল নির্মমতা ও নিষ্টুরতায় একেবরে ঠাসা। নির্বাসনের আগেই অসহায় মুসলিম তাতারিদের থেকে তাদের জীবনোপকরণ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এরপর তাদেরকে মালবাহী রেলের বগীতে বস্তায় তুলা ঢুকানোর মত এমন গাদাগাদি করে ঠাসা হয়েছিল যে, যখন রেল সাইবেরিয়ায় গিয়ে উপনীত হয় তখন দেখা যায়, প্রতি বগীতে জীবিতদের চেয়ে মৃতদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কারণ সুদীর্ঘ এই বিরামহীন যাত্রায় তারা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আর অসহ্য ভ্যাপসা গরমে কণ্ঠতালু শুকিয়ে মারা পড়েছিল। জীবনধারণের সবগুলো উপকরণ ছিনিয়ে নেয়ার দরুণ তাবুর জীবনও তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল হীম-শীতল জাহান্নামের মতো। ওখানেও ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর শীতের প্রকোপে বেশিরভাগ তাতারি মারা পড়েছিল।
১৯৪৪ থেকে শুরু হয়ে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই নির্মূল প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। ১৯৪৬ সালে নামকে ওয়াস্তে শ্বায়ত্বশাসনটুকু উঠিয়ে নেয়া হয়। তখন থেকে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। আর এর মাধ্যমে নির্মূলপ্রক্রিয়া একবারে চরমে গিয়ে পৌঁছায়। কী অপরাধ ছিল তাতারিদের? অপরাধ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র (?) এ নিমূল প্রক্রিয়া কেবল জতিগত নির্মূলীকরণের মধ্যেই সীমিত ছিল না, বরং নির্মূল অভিযান চলছিল তাদের ঈমান-আকিদা, সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও। সুতরাং এ যাত্রায় ক্রিমিয়ায় মুসলিম ঐতিহ্যের কোনো চিহ্নই আর অবশিষ্ট রাখা হয় নি। হাজারো ঝড়-ঝাপটা সয়ে যেসব মুসলিম কীর্তি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবার সে গুলোকেও ধ্বংস করে দেয়া হয়। এতে প্রত্নতত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই চিরতরে হারিয়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর মসজিদগুলোকে রূপান্তরিত করা হয় ক্লাব আর সিনেমায়। সমৃদ্ধ লাইব্রেরীগুলোকে জ্বালিয়ে করা হয় ছাইএর পাহাড়। এরপর ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোনো পক্ষের আবেদন ছাড়াই ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ইউক্রেনের সাথে। আর এভাবেই সমৃদ্ধ ক্রিমিয়া হারিয়ে যায় মুসলিম বিশ্বের মাণচিত্র থেকে।

দায় মুক্তির ঘোষণা:

অনেকদিন পর ১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংস নির্মূল অভিযান এবং হত্যাযজ্ঞের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু এ-তো ছিল “জুতা মেরে গরু দানের” মতো বিষয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন নাজিদের সাথে তাতারিদের সম্পর্কের অভিযোগটাও ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু এতোটুকু বোধোদয় হবার পরও যে ক্রিমিয়দের তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তাদেরকে নিজেদের জায়গায় আবাসিত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। নাইবা তাদের থেকে ছিনিয়ে নেয়া তাদের জমিজমা তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। বর্বর শ্বেতভল্লুকদের আগ্রাসনের শিকার হয়ে আজ হারিয়ে গেছে মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন ক্রিমিয়া। আজ সেখানে মুসলমানরা পরবাসীর ন্যায় সংখ্যালঘু। আহ! কী বেদনাদায়ক সে ইতিহাস। অব্যাহত নির্মূল অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৩ সালে যেখানে তাতারিদের সংখ্যা ছিল ৯ মিলিয়ন ১৯৪১ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৮৫০ হাজারে। বর্তমানে ক্রিমিয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র ২৬০ হাজার।
কী জবাব দেবে মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর দরবারে এ উদাসীনতার? শুধু কি কাঁদলেই হবে এ সমস্যার সমাধান? এভাবে কি একে একে হারিয়ে যেতে থাকবে মুসলিম অধ্যুসিত এলাকা? না কি ইতিহাসের মোড় ঘোড়ানোর চিন্তা করতে হবে সমকালীন মুসলিম উম্মাহকে? মোড় ঘোড়ানো কি কঠিন? ইতিহাসের চলন তো সরল পথে নয় বরং বৃত্তপথে। সুতরাং মোড় ঘুরবেই ইনশাআল্লাহ। তবে এর জন্য কুরবানী দিতে হবে। ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হবে।

সূত্র. রাবেতা একটি পুরনো সংখ্যা থেকে অনূদিত।