বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৫:৫৪
Home / প্রতিদিন / ’সেকুলার চিন্তাধারা‘ না বলে আমি ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তাই বলবো- ফরীদ আহমদ রেজা
ফরীদ আহমদ রেজা

’সেকুলার চিন্তাধারা‘ না বলে আমি ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তাই বলবো- ফরীদ আহমদ রেজা

‘ছাত্র রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের জন্ম হয়েছে এবং লেখাপড়ার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। তাই আমি শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে। এ ব্যাপারে আমার কিছু লেখাও আছে। ছাত্ররা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হোক তা আমি চাই না। তাদের রাজনৈতিক মতামত থাকবে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, রাজনীতি নিয়ে একাডেমিক আলোচনায় অংশ নিবে। কেউ ইচ্ছা করলে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন থাকবে রাজনীতি মুক্ত।’-


ফরীদ আহমদ রেজা। একজন শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, কলামিস্ট। যৌবনে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রাজনীতির ময়দানে। স্বাধীনতার প্রশ্নে জামায়াত-শিবির থেকে আলাদা হয়ে যুবশিবির প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চলে আসেন ব্রিটেনে। কিন্তু থামেনি শিক্ষা ও গবেষণার কাজ।

একজন জাতসাহিত্যিক চিন্তকের মুখোমুখি একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে। শিক্ষা, রাজনীতি, দেশীয়, আন্তর্জাতিক, সামাজিক ও ধর্মীয়সহ নানা বিষয় নিয়ে হয়েছে বিস্তর আলোচনা। সুখ, দুঃখ, আশা ও নিরাশার দোলাচলে উম্মাহর মুক্তির পথ নিয়ে যৌক্তিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। আসুন আলাপে আলাপে জেনে নেই গণমানুষের দরদী এই ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি…!

কমাশিসা:  কী কী কাজ নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটান? লেখালেখি কেমন চলছে? এ পর্যন্ত কয়টি গ্রন্থ প্রকাশ পেল?

ফরীদ আহমদ রেজা: পড়ালেখা, অবৈতনিক শিক্ষকতা, খণ্ডকালীন কাজ, পরিবারিক এবং সামাজিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। তাদের দেখাশোনা করতে হয় না। তবু তাদের সাথে প্রচুর সময় দিতে হয়। তাদের মনে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও পড়াশোনা করতে হয়।

বই প্রকাশিত হয়েছে মাত্র দু’টো। অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে। নিজের ব্যস্ততা এবং প্রকাশকের অভাবে সেগুলো পড়ে আছে।

কমাশিসা:  শিক্ষকতার পেশা সখে না দায়িত্ব হিসেবে করে যাচ্ছেন? একজন শিক্ষকের কী কী গুণাবলি থাকা উচিত বলে মনে করেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: পূর্বে শিক্ষকতাই পেশা ছিল। পেশাগত শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছি। এখন বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করি, দায়িত্ব এবং শখের কাজ হিসেবে।

শিক্ষকের গুণাবলী বলতে গেলে এ বিষয়ে আলাদা নিবন্ধ লিখতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একজন শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের মানসিকতা এবং ছাত্রদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থাকা সবচেয়ে জরুরী। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত আমরা সবাই ছাত্র। নতুন জিনিস জানার আগ্রহ এবং ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে কারো শিক্ষকতা পেশায় থাকা উচিত নয়।

কমাশিসা:  বিলেতের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুলের অবকাঠামো, ব্যবস্থাপনা, সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতির সাথে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার সামঞ্জস্য, দূরত্ব বা ফারাক কতটুকু- একটু আলোকপাত করবেন?

ফরীদ আহমদ রেজা:  এ সকল প্রশ্নের জবাব সংক্ষেপে দেয়ার সুযোগ নেই। তবু আমি চেষ্টা করবো।

বিলাতের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডোরি স্কুলগুলো প্রধাননত দু’রকমের। একটা পাবলিক স্কুল এবং অপরটা প্রাইভেট স্কুল। পাবলিক স্কুলগুলো দেখাশোনার প্রধান দায়িত্ব স্থানীয় কাউন্সিলের। তবে কেন্দ্রিয় সরকার কারিকুলাম, শিক্ষার মান, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, চাইল্ড প্রটেকশন, শিক্ষকদের মান, নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় দেখাশোনা করে। নতুনভাবে চালু হওয়া একাডেমি এবং ফ্রি-স্কুলগুলো প্রকৃতির দিক দিয়ে অনেকটা প্রাইভেট স্কুলের মতো।

সিলেবাস এবং পাঠদান পদ্ধতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাথে বিলাতের অনেক পার্থক্য রয়েছে। এ দেশের সিলেবাস কর্মমুখি এবং পাঠদান পদ্ধতি বাস্তবমুখি। আমরা দেখি, অনেক ছাত্রছাত্রী প্রাইমারি স্কুলের প্রথম বর্ষে যখন ভর্তি হয়, তখন হয়তো একটি ইংরেজি শব্দও জানে না। কিন্তু দু’বছরের মধ্যে তারা ইংরেজি ভাষায় পড়া, লেখা এবং কথা বলা শিখে ফেলে। এককথায় এ দেশের স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ঢুকে তারা কিছু শিখে সেখান থেকে বের হয়।

কমাশিসা:  সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা বলতে কী বোঝায়? একটি মুসলিম প্রধান দেশের শিক্ষাটা সর্বজনীন হওয়ার ফর্মুলাটা কী হতে পারে? ইসলামের সোনালি যুগের শিক্ষাব্যবস্থা ও বর্তমান পরিস্থিতির উপর আপনার মতামত জানতে চাই।

ফরীদ আহমদ রেজা: সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা বলতে আমি সকলের জন্যে শিক্ষা বুঝি। শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে মানুষ হিসেবে গঠন করা। এ কথাটা মুসলিম-অমুসলিম সকলের জন্যে প্রযোজ্য। মুসলিম-প্রধান দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকতে হবে।

ইসলামের সোনালি যুগে মানুষের লেখাপড়া শুরু হতো কুরআন দিয়ে। লেখাপড়া শেখা, কুরআন মুখস্ত এবং কুরআনের ভাষা শিক্ষা করার পর বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র দিয়ে শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হতো।

গোলামি যুগের সবচেয়ে মারাত্মক দিক হলো কুরআনের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কচ্যুতি। অত্যন্ত কৌশলের সাথে তারা কাজটি করেছে। ক্রসেড বা হালাকু খাঁর আক্রমণে মুসলমানরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এরচে’ অনেক অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে গোলামি যুগের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। অশিক্ষিত আরব জনগোষ্ঠী কুরআন ধারণ করে ক্ষমতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ আসন দখল করে নিয়েছিল। কুরআনের সে ক্ষমতা এখনো অটুট রয়েছে। কিন্তু আমরা মুসলমানরাই কুরআনকে পরিত্যাগ করে উন্নয়নের চেষ্টা করছি। ফলে আমরা এমন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করছি যারা বাঘের মতো হিংস্র, কারুনের মতো লোভী এবং শেয়ালের মতো ধূর্ত। এরা না উন্নয়নের সহায়ক আর না তাদের হাতে কারো জীবন, সম্পদ বা সম্মান নিরাপদ।

কমাশিসা:  একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষার ভূমিকা কতটুকু?

ফরীদ আহমদ রেজা: সত্যি বলতে কি, মুসলমানদের আসল সঙ্কট এখানেই। শিক্ষিত সমাজ একটি জাতিকে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে না, তাদের উন্নত জীবনাচার, দেশ ও জাতির জন্যে অনুসরণীয় রোল-মডেল, যা জাতিকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়। রোল-মডেল বা নমুনা প্রত্যক্ষ করা এবং এর সাথে সোহবত বা সংসর্গই মানুষের মধ্যে সত্যিকার পরিবর্তন সাধিত হয়। জাতি গঠনের কাজে সে তুলনায় বই-পুস্তক বা ওয়াজ-নসিহতের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। আদর্শ মানুষ তৈরি করতে হলে সে লক্ষ্যে সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। মুসলিম বিশ্বের যারা পরিচালক তাদের মধ্যে সে চিন্তা ও উদ্যোগ কি আছে?

কমাশিসা:  সাধারণভাবে বলা হয় মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া জাতি। আধুনিক সকল আবিষ্কারে নাকি মুসলমানদের কোনো অবদান নেই? এখানে বাস্তবতা আসলে কী? জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিষ্কারে কেন তারা পিছিয়ে আছে? উত্তরণের কোন পথ আছে?

ফরীদ আহমদ রেজা: মুসলমানরা আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃত, এটা কোনো বিতর্কিত বিষয় নয়। মুসলমানরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখেন তখন আজকের ইউরোপ ছিল ঘোর অন্ধকারে।

বর্তমানে মুসলমানরা পিছিয়ে আছে, এ ব্যাপারেও বিতর্ক করার কোনো অবকাশ নেই। সোনালি যুগের মুসলমান পণ্ডিতগণ কুরআন থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনা পেয়েছেন। বর্তমান সময়ের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কুরআন বোঝেন না, বিষয়টা শুধু তা নয়। কুরআন থেকে আরো দূরে সরে যাবার জন্যে এক শ্রেণির মুসলমান নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা করে চলেছেন।

আমরা জানি, বিশ্বপ্রকৃতির পরতে পরতে আল্লাহর নিদর্শন বিদ্যমান। অথচ পার্থিব-বিদ্যা বিবেচনা করে দর্শন, অর্থশাস্ত্র, গণিত, সমাজবিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের প্রতি মুসলিম পণ্ডিতদের উন্নাসিকতা কোনো গোপন বিষয় নয়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আবিষ্কারে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে পিছিয়ে আছেন।

কমাশিসা:  বর্তমান মুসলিমবিশ্ব প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদিদের আগ্রাসনের শিকার। এখানে প্রশ্ন হলো এই আগ্রাসন কি অনিবার্য ছিলো? মুসলমানরা তাদের দেশ, মাটি, জাতিকে বৈরী শক্তি থেকে রক্ষা করতে পারছে না কেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: মুসলমানদের অবস্থা বিবেচনা করলে এটা স্বীকার করতে হয় যে, মুসলমানদের আগ্রাসনের শিকার হওয়াটা অনিবার্য ছিল। জয়-পরাজয় এবং নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। তবে খোদায়ি বিধান অন্ধ ও বধির নয়; পক্ষপাতদুষ্টও নয়। অযোগ্য ও মেধাহীন লোকদের হাতে আল্লাহ দুনিয়ার নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব প্রদান করেন না। নেতৃত্বের যোগ্যতা মুসলমানরা হারিয়ে ফেলেছিল বলেই মুসলিমবিশ্ব আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

কমাশিসা:  আমরা দেখি দেশে দেশে মুসলমানদের ভিটে-মাটি পুড়িয়ে ছারখার করে তাদের বংশ বিনাশও চলছে সমান্তরাল। কিন্তু অপবাদ দেয়া হয় যে, ইসলাম ও মুসলিমরাই কেবল সন্ত্রাসবাদে জড়িত? আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: আজকের যুগে মিডিয়া স্কাড-মিসাইল থেকে অনেক শক্তিশালী। মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার কাজটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুগামী হিসেবে মিডিয়া-ই করে চলেছে। নিজেদের চৌকস সংবাদকর্মী এবং শক্তিশালী মিডিয়া না থাকলে এ সকল অপবাদের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সাংবাদিক এবং মিডিয়া আমাদের কাছে অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। আমাদের ফোকাস ভিন্ন দিকে।

কমাশিসা:  বিশ্বে শক্তির ভারসাম্য তৈরি করতে হলে মুসলিম দেশগুলো কী উদ্যোগ নেয়া জরুরি মনে করেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং জনশক্তির মানোন্নয়ন আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন-সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। শক্তিশালী জোটবদ্ধ অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে এ দু’টো সম্পদকে সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করতে পারলে বিশ্ব-নেতৃত্ব মুসলিম বিশ্বের হাতের মুঠোয় চলে আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

কমাশিসা: জাতিসংঘের ভূমিকাকে বিশ্ব পরিস্থিতিতে কি কার্যকর বলে মনে করেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: আমার দৃষ্টিতে জাতিসংঘ বৃহৎশক্তির একটা বিনোদন ক্লাবের চেয়ে বড় কিছু নয়। বৃহৎশক্তি, বিশেষ করে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা জাতিসংঘের নেই। মার্কিন অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে জাতিসংঘকে নিজের সদর দফতর গুটিয়ে ফেলতে হবে। ‘বাপুরাম সাপুড়ে’ কবিতায় কথিত “নখ নেই, শিং নেই” – এমন সাপ’র প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক।

কমাশিসা:  মুসলিম বিশ্বের সীমাহীন দুর্ভোগ ও কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের উপায় কী?

ফরীদ আহমদ রেজা: মুসলিম বিশ্বের সীমাহীন দুর্ভোগ ও কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের উপায় হচ্ছে কুরআনের কাছে ফিরে যাওয়া। আন্তরিকতার সাথে কুরআনের কাছে ফিরে গেলে মুসলিম বিশ্বে ঐক্য ফিরে আসবে। নিদ্রিত মুসলমানরা ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে জাগ্রত হবে। আল্লাহ তো বলে দিয়েছেন, “কোনো জাতি নিজে পরিবর্তিত না হলে তিনি তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেন না”।

কমাশিসা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ভবিষ্যৎ কেমন আছে? কীরূপ যাচ্ছে? কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ব্যাপারে কিছু বলুন।

ফরীদ আহমদ রেজা: ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, কারণ মেঘের আড়ালে সবসময় সূর্য হাসে। সমস্যা হচ্ছে, সে সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্যে যে নেতৃত্বের দরকার তা বেরিয়ে আসছে না বা তৈরি হচ্ছে না।

সাংস্কৃতিক অঙ্গন কখনো খালি থাকে না। আগ্রাসন ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা না থাকলেই আগ্রাসন সফল হয়। যারা সুস্থ সংস্কৃতির কথা ভাবেন তারা এগিয়ে এলে অসুস্থ ধারা পালাতে বাধ্য।

কমাশিসা:  বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দু’টি বলয়; ইসলামিক ভাবনার ও সেকুলার চিন্তাধারার। এ দু’টি ধারা ক্রমশ সংঘাতের দিকে ধাবমান নাকি সমন্বয় ও সমঝোতার দিকে অগ্রসরমান বলে মনে করেন?

ফরীদ আহমদ রেজা:  ‘সেকুলার চিন্তাধারা’ সম্পর্কে আমার ভিন্নরকম কথা আছে। এ জন্যে আমি ’সেকুলার চিন্তাধারা‘ না বলে ইসলামবিদ্বেষী চিন্তা বলতে চাই।

ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তাধারা যারা লালন করে তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের নিরাপদ বলয়ে বিচরণ করে। খোলাখুলি মাঠে আসার সাহস এবং শক্তি কোনোটাই তাদের নেই। ইসলামি ধারা কার্যকরভাবে প্রবল হলে ইসলামবিদ্বেষী মহল হালে পানি পাবে না বলে আমার বিশ্বাস।

কমাশিসা:  বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৬ বছর। ধনী-গরিব উঁচু-নীচুর ব্যবধান পাহাড়সম। সামাজিক ন্যায়বিচার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা- জনগণ মৌলিক এই অধিকারগুলো থেকে কেন এখনো বঞ্চিত হচ্ছে?

ফরীদ আহমদ রেজা: স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায় বিচার। যারা দেশ পরিচালনায় ছিলেন বা আছেন তারা এ তিনটি মূলনীতি কতটুকু বিশ্বাস করেন এবং নিজেদের পরিসরে মেনে চলেন? বিশ্বাস এবং সে বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ একে ওপরের পরিপূরক, পাশাপাশি হাঁটে।

স্বার্থপর এবং অসৎ লোক ক্ষমতায় থাকার কারণে মানুষ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। স্বার্থপর এবং অসৎ লোকদের নিকট থেকে জনগণের প্রতি ভালোবাসা আশা করা যায় না।

ক্ষমতা কেউ কারো হাতে তুলে দেয় না, ক্ষমতা চেষ্টা-সাধনা করে অর্জন করতে হয়। মানুষের সামনে যোগ্য বিকল্প না থাকলে স্বার্থপর এবং অসৎ লোক বারবার ক্ষমতায় আসবে।

আমার মতে, জনগণ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে, এর কারণ সৎ ও নিঃস্বার্থ লোকদের অযোগ্যতা এবং নিষ্ক্রিয়তা।

কমাশিসা:  ইসলামি রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান পরিস্থিতিকে তাদের জন্য বিপর্যয়, নাকি তারা মজলুম, নাকি তারা তাদের কর্মফল ভোগ করছে বলে মনে করেন? অন্যন্য ইসলামি দলগুলোর ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

ফরীদ আহমদ রেজা: জামায়াতে ইসলামীর অনেক দোষ আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তারা মজলুম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোনো মানুষের উপর এরকম জুলুম সমর্থনযোগ্য নয়।

অন্যান্য ইসলামি দল ভিন্ন রাজনৈতিক ধারা বা বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। রাজনৈতিক বক্তব্য এবং কর্মকৌশলের দিক দিয়ে তারা সবাই কম-বেশি জামায়াতে ইসলামীর কপি-ক্যাট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় কিছু করতে হলে সে ছাঁচ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

কমাশিসা:  আপনি জানেন, বাংলাদেশে স্কুল আলিয়া ও কওমি তিন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি বিরাজমান। আরো আছে প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। প্রশ্ন হলো একটি সমৃদ্ধ ঐক্যবদ্ধ জাতির জন্য বিভিন্নমুখী শিক্ষাপদ্ধতি চিন্তা, চেতনা ও মনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে না?

ফরীদ আহমদ রেজা: বিরূপ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই ফেলবে। বাস্তবে আমরা সেটাই দেখছি। তিন ধারার শিক্ষাপদ্ধতি তিন ধরনের মানুষ তৈরি করছে। তাদের পারস্পরিক পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব দিনে দিনে অধিকতর স্পষ্ট ও জটিল হচ্ছে।

কমাশিসা:  আপনি কোনো এক জামানায় ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এখন কি কোনো রাজনৈতিক দলে সক্রিয় আছেন? না থাকলে কেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: কোন রাজনৈতিক দলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। বর্তমান সময়ে রাজনীতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতির হাত এখন মানুষের শোবার ঘর পর্যন্ত প্রসারিত। এর মানে এ নয় যে, সবাইকে অবশ্যই সক্রিয় রাজনীতি করতে হবে অথবা প্রচলিত কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে।

কমাশিসা: পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই ছাত্র রাজনীতি নেই। শিক্ষাঙ্গন রাজনৈতিক কোলাহলমুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশেই একমাত্র দেশ যেখানে কলমের বদলে পিস্তল, বইয়ের বদলে দলীয় কাসুন্দী, খাতার বদলে বোমা বহন করে চলে! আপনি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে?

ফরীদ আহমদ রেজা: ছাত্র রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের জন্ম হয়েছে এবং লেখাপড়ার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। তাই আমি শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে। এ ব্যাপারে আমার কিছু লেখাও আছে। ছাত্ররা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হোক তা আমি চাই না। তাদের রাজনৈতিক মতামত থাকবে, ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, রাজনীতি নিয়ে একাডেমিক আলোচনায় অংশ নিবে। কেউ ইচ্ছা করলে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যোগ দিতে পারবে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন থাকবে রাজনীতি মুক্ত।

কমাশিসা:  বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষাসনদের স্বীকৃতির বিষয়ে সরকার মহলে আগ্রহ আছে। কিন্তু খোদ কওমিরা দ্বিধাবিভক্ত। রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় অংশীদারিত্ব না হয়ে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখছেন? শিক্ষা শেষে তারা দেশে কীভাবে ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন?

ফরীদ আহমদ রেজা: ‘দান গ্রহণ করো, কিন্তু দান যদি ঘুষ হয় তা হলে তা পরিহার করো।’ এটা মুসলমানদের মূলনীতি। কিন্তু নিজ দেশের সরকারের নিকট থেকে কোনো সুবিধা গ্রহণ দান নয়; বরং অধিকার। দেশটা আমাদের। আমাদের টাকায় সরকার চলে।

সরকারি স্বীকৃতির এক অর্থ হলো, ‘সনদ’কে স্বীকৃতি দেয়া। সরকারি স্বীকৃতি থাকলে চাকরি, দেশে এবং বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমার মতে এ অধিকার বর্জনের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। যারা এর বিপক্ষে তাদের যুক্তি আমার কাছে বোধগম্য নয়।

সরকারি স্বীকৃতির সাথে সরকারি অনুদানও আসবে। এটা ঘুষ নয়; কর্মের স্বীকৃতি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটা তাদের প্রাপ্য অধিকার। এ অধিকার থেকে কওমি শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত রাখার মধ্যে দ্বীনি বা পার্থিব কোনো কল্যাণ নেই।

সরকারি সনদ বা স্বীকৃতি গোলামীর দাসখত নয়। সরকার এসব সুবিধা দিয়ে কওমি মাদ্রাসাকে কিনতে পারবে না, অন্যায়-অবৈধ সুবিধা আদায় করতে পারবে না। সরকার যদি তা করতে চায়, তাহলে কওমি-শিক্ষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের তা প্রত্যাখ্যান করার মানসিকতা ও সাহস রয়েছে।

কমাশিসা:  আপনার শৈশব-কৈশোর, জন্মস্থান, পিতা-মাতা, পরিবার ও শিক্ষাজীবন নিয়ে কিছু বলুন।

ফরীদ আহমদ রেজা: বৃহত্তর সিলেটের সৈয়দপুর গ্রামে আমার জন্ম। কুরআন, বাংলা এবং উর্দু শিক্ষার প্রথম শিক্ষক আমার আম্মা। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া গ্রামের মডেল প্রাইমারি স্কুল, সুনামগঞ্জ এইচএমপি হাই স্কুল, সৈয়দপুর আলিয়া মাদরাসা, সিলেট আলিয়া মাদরাসা, এমসি কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছি। বিলাতে আসার পর লন্ডনের ইউনিভিার্সিটি অব ইস্ট লন্ডন থেকে পিজিসিই এবং ইনস্টিটিউট অবএডুকেশন থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা গ্রহণ করেছি।

আমার আব্বা এবং দাদা – দুজনই মরমী কবি ছিলেন। লেখালেখির প্রেরণা সেখান থেকেই পেয়েছি। আব্বার একটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। আমার শৈশব এবং কৈশোরের অনেক স্বপ্ন এবং কর্মের সাথে সে লাইব্রেরি জড়িয়ে আছে। আমার ‘আমি’ হয়ে ওঠার পেছনে এর অবদান অপরিসীম।

কমাশিসা:  ইউরোপে মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কেমন? করণীয়-বর্জনীয় নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক কিছু বলুন।

ফরীদ আহমদ রেজা:  আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের কাছে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডা ভিন্ন কোন দেশ নয়। সকল দেশই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর বান্দা হিসেবে পৃথিবীর সকল দেশই আমাদের। আমরা যে কোনো দেশকে থাকার জন্যে গ্রহণ করে নিতে পারি। আমরা মুসলমানরা যে দেশে বাস করি, সে দেশকে ভালোবাসি, সে দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সে দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের কাজে শরিক হই।

ইউরোপে, বিশেষ করে বিলাতে মুসলমানদের অবস্থানকে সাহাবাদের হাবশা হিজরতের সাথে তুলনা করা যায়। একটি রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে জনগণের মৌলিক অধিকার, সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করা। বিলাতের মুসলমানগণ যে সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরিই উপভোগ করছেন। এর শোকরিয়া হিসেবে আমাদের এ দেশের উন্নয়ন এবং এ দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যে কাজ করা দরকার।

আমরা রাহমানুর রাহীমের বান্দা, রাহমাতুল্লিল আলামীনের উম্মাত। আমরা ঘৃণার বাণী প্রচার করি না। আমরা ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বাণী প্রচার করি।

আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের আশেপাশে যারা বাস করে তারা ভিন্নধর্মের অনুসারী। তারা কুরআন-হাদিস পাঠ করে না। তারা মিডিয়া থেকে খবর পায় এবং মুসলমানদের ’পাঠ’ করে। আমাদের কাজের সাথে মিডিয়ায় প্রচারিত খবরের মিল দেখলে মিডিয়াকে বিশ্বাস করে। আর অমিল দেখলে বুঝতে পারে, মিডিয়া মিথ্যাচার করছে।

মহানবী সা. মক্কায় চল্লিশ বছর যাবৎ চুপচাপ থেকেছেন। ইসলামের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। মানুষ তাঁকে দেখে আল আমীন উপাধি দিয়েছে। আমরা মুসলমানরা মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে অনেক দিন থেকে বাস করছি। আমরা কয়জন ‘আল আমীন’ হতে পেরেছি।

কমাশিসা : সময় দেয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।

ফরীদ আহমদ রেজা: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...