শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:০১
Home / জীবন জিজ্ঞাসা / সুদ বিষয়ে আলেম ওলামার উদারনীতি এবং আমাদের দায়হীন দায়বদ্ধতা

সুদ বিষয়ে আলেম ওলামার উদারনীতি এবং আমাদের দায়হীন দায়বদ্ধতা

ইকবাল হাসান জাহিদ :

একজন আলেম যখন সুদকে হারাম বলবেন, আর ব্যবসাকে হালাল বলবেন, তখন সাধারণ মানুষ সহজেই তার কথাগুলো মেনে নেবে। কিন্তু এই তিনি যখন নিজেই সুদকর্মে জড়িয়ে যাবেন। সুদ নিজেও খাবেন অন্যকেও খেতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করবেন, এমনকি সহযোগিতার পাশাপাশি সুদকে একধরণের জরুরী বিষয় হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করার একশো খুড়া যুক্তি উপস্থাপন করবেন, তখন ধরে নিতে হবে এই সমাজ আর খুব বেশি দিন টিকে থাকবে না। (লেখাটা একটু লম্বা।পুরো পড়লে আশাকরি কাজে লাগবে)

তিনি একজন ব্যবসায়ী সাজার পরপরই যখন বলবেন, আরে ভাই ব্যাংকের লোন ছাড়া ব্যবসা কি হয়? আরে ভাই সুদভিত্তিক ঋণ ছাড়া কি ব্যবসায় ঠিকে থাকা যায়? অথবা বলবেন, আপনি তো দুইটাকার ছটাকি মোল্লা, মাদরাসায় বসে বসে ফতোয়া টানছেন। নেমে দেখেন ব্যবসায়, কতধানে কতচাল। এই রকম তেলেসমাতি বক্তব্য দিয়ে সুদভিত্তিক ব্যবসার বিরুদ্ধে ওয়াজ নসিহত করা থেকে মাদরাসার মুহতামিমের মাধ্যমে মুফতি সাহেবকে কাউন্টার করবেন তখন ভাবতে হবে কেয়ামত অতি নিকটে। কারণ আল্লাহপাক দুনিয়া ধ্বংসের আগে আলেম ওলামাকে উঠিয়ে নেবেন। আর এটা পাকাপোক্ত হবে ইলম উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। আমল ছাড়া আলেম মহাপাপী জালেমের অভাব থাকবে না সমাজে। শাদা পাঞ্জাবি আর শাদা টুপি পরে থাকা অসংখ্য আলেমের সম্মিলন দেখা যাবে, কিন্তু থাকবেন না শুধু প্রকৃত আলেম।

আলেম ওলামারা ব্যবসায় নামছেন শুনে অ-ব্যবসায়ী আল্লাহর ওলীরা বড়ই আনন্দ প্রকাশ করছেন। আমরা যারা সাধারণ পাবলিক তারাও আনন্দিত। ব্যবসা আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ মুস্তফা সা. থেকে শুরু করে সকল আম্বিয়া রাসুলগণের সুন্নাত। কুরআনে কারীমে কোনো চাকুরীর কথা ডাইরেক্ট উল্লেখ না থাকলেও ব্যবসার কথা আল্লাহপাক ডাইরেক্ট উল্লেখ করেছেন। “আহাল্লাল্লাহুল বাইআ ওয়াহাররামার রিবা” ব্যবসাকে আল্লাহপাক করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম।

বর্তমান বিশ্বের আলেম ওলামারা ব্যবসার সাথে অনেকটাই সংশ্লিষ্ট হচ্ছেন। বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দির আলেমদের ব্যবসায় পদচারণা আমাদেরকে অনেক বেশি আপ্লুত ও আনন্দিত করছে। আল্লাহর জমিনের সবচে হালাল রিজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষজন তার জীবন যাপন করছে। আর যদি এই সেক্টরে আলেমদের পদচারণা হয় তাইলে তো মাশাল্লাহ।

কিন্তু! শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, আলেম ওলামাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত ব্যবসাগুলোতেও যখন সুদভিত্তিক লেনদেন হচ্ছে শুনা যাবে, কিংবা আলেমদের ব্যবসার জন্মই হবে সুদভিত্তিক পুঁজির ম্যাধমে তখন জাতির কপালে কিইবা আর করার থাকবে।

মাদরাসায় ১৬ বছর পড়ালেখা করে একজন আলেম যখন শতস্ফুর্তভাবে সুন্নতী ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। তখন তার পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, বিশেষ করে তার উস্তাজমহোদগণ তাকিয়ে থাকবে এই ভেবে যে অন্তত সমাজে একটা সুদমুক্ত ব্যবসার চালু হলো। একটা প্রকৃত দ্বীনী ব্যবসার মাধ্যমে হান্ড্রেড পার্সেন্ট হালাল টাকার সন্ধান পাওয়া যাবে। অথচ, ঠিক এর বিরপরীতে যখন ওই আলেম সুদভিত্তিক ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসার কাজে লাগাবেন। বড় কোনো মজুতদার সুদি মহাজনের কাছ থেকে সুদের ভিত্তিতে টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসার কাজ পরিচালনা করবেন তখন এই অলেম একদিকে যেমন নিজেকে সরাসরি আল্লাহর সাথে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার ঘোষনা করলেন, অন্যদিকে তার উপর ভরসা করে বসে থাকা পরিবার পরিজন, আত্মিয় সজন, বন্ধুবান্ধব, উস্তাজমহোদয়গণ তার থেকে যা পাবেন তা টয়লেটের নিকৃষ্ট নাজাসত থেকেও গর্হিত।

আল্লাহপাক এই সুদ সম্পর্কে সরাসরি কুরআনে যেই সকল আয়াত বলেছেন, এইগুলো পড়লে আপনারা নিশ্চত বুঝে যাবেন, সুদ কতটুকুপর্যায়ের জঘণ্য ও নিকৃষ্ট জিনিস।

সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত:–
১) যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করেপাগল করে দিয়েছে৷ তাদের এই অবস্থায় উপনীত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলেঃ “ব্যবসা তো সুদেরই মতো ৷” অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকেকরেছেন হারাম ৷ কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌছে যায়এবং ভবিষ্যতে সুদখোরী থেকে সে বিরত হয়, সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়েফেলেছেই এবং এ ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ হয়ে গেছে ৷ আর এই নির্দেশের পরও যেব্যক্তি আবার এই কাজ করে , সে জাহান্নামের অধিবাসী ৷ সেখানে সে থাকবে চিরকাল৷(আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৫)

২) আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত ও বিকশিত করেন ৷ আর আল্লাহঅকৃতজ্ঞ দুষ্কৃতকারীকে পছন্দ করেন না ৷(আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৬)

৩) হে ঈমানদারগণ ! আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়েগেছে তা ছেড়ে দাও , যদি যথার্থই তোমরা ঈমান এনে থাকো।(আলবাকারাহ,আয়াতঃ২৭৮)

৪) কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো তাহলে জেনে রাখো, এটা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষথেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ৷ এখনো তাওবা করে নাও ( এবং সুদ ছেড়ে দাও )তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে ৷ তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদেরওপর জুলুম করাও হবে না ৷(আল বাকারাহ,আয়াতঃ২৭৯)

৫) হে ঈমানদারগণ ! চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া বন্ধ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, আশাকরা যায় তোমরা সফলকাম হবে ৷(আলে ইমরান,আয়াতঃ ১৩০)

৬) সুদ গ্রহণ করার জন্য যা গ্রহণ করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবেলোকদের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য, আমি এমন অনেক পাক-পবিত্র জিনিস তাদের জন্যহারাম করে দিয়েছি, যা পূর্বে তাদের জন্য হালাল ছিল৷ আর তাদের মধ্য থেকে যারা কাফেরতাদের জন্য কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরী করে রেখেছি৷ (আন নেসা,আয়াতঃ ১৬১)

৭) যে সূদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহরকাছে তা বাড়ে না ৷ আর যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকো,তা প্রদানকারী আসলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করে৷(আর রূম,আয়াতঃ ৩৯)

সুদ সম্পর্কে রাসুলের হাদীস:-
১) হযরত মূসা ইবনে ইসমাঈল (রঃ)……সামুরা ইবনে জুনদুব (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট এসে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌছলাম। নদীর মাঝখানে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানের লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায়, তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খন্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে সে যতবার বেরিয়ে আসতে চায়,ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি রক্তের নদীতে দেখছেন, সে হল সূদখোর। (বুখারীঃঅধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়ঃ ১৯৫৫)

২) হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী জিনিস থেকে বিরত থাক। জিজ্ঞেস করা হল,হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ), সে গুলো কি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, যাদু টোনা করা, আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন এমন প্রাণীকে অকারণে হত্যা করা, এতীমের মাল আত্মসাত করা,সুদ খাওয়া,জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং সতী সাধ্বী নিষ্কলুষ মুমিন মহিলার উপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। (মুসলিম, কিতাবুল ইমানঃ১৭০)

৩) হযরত আহমদ ইবনে ইউনুস(রঃ)…..আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) সূদখোর, সূদ দাতা,এর সাক্ষী এবং সুদের হিসাব/দলীল লেখক—সকল কে অভিশাপ দিয়েছেন। আর তিনি এদের সবাই কে সমান অপরাধী বলেছেন।(আবু দাউদ,অধ্যায়ঃ ক্রয়-বিক্রয়ঃ ৩৩০০)

৪) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সাঈদ (রঃ)…..আবু হুরাইরাহ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, সুদের সত্তরটি স্তর রয়েছে। সবচেয়ে নিম্নটি হল-নিজ মায়ের সাথে ব্যভিচার করা (ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৪)

৫) হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মিরাজের রাতে আমি এমন এক গোত্রের পাশ দিয়ে গমন করি,যাদের পেট ছিল ঘরের মত বড়, যার মধ্যে বিভিন্ন রকম সাপ বাহির থেকে দেখা যাচ্ছিল। আমি জিবরাঈলকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হল সুদখোর।(ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৩)

৬) হযরত আব্বাস ইবনে জাফর(রঃ)…..ইবনে মাসউদ (রাঃ) সুত্রে রাসূল (সাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে বেশী সুদ খাবে, পরিনামে তার সম্পদ কম হয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ,অধ্যায়ঃ ব্যবসাঃসুদঃ ২২৭৯)

৭) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালাহ(রাঃ)থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, জেনেশুনে এক দিরহাম পরিমান সুদ খাওয়া আল্লাহর নিকট ছত্রিশ বার ব্যভিচারের চাইতেও অধিক গুনাহের কাজ। (মুসনাদে আহমদঃ১০৩৩)

চলবে ইনশাআল্লাহ…

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...