বৃহস্পতিবার, ২৮শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৬:৫৭
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ১৮ (খ)

সমুদ্র ঈগল ১৮ (খ)

কুতায়বা আহসান :

– তিনি অত্যন্ত শক্ত কন্ঠে বললেন: আমি আজ এই মুহূর্তেই যদি তোমাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনে এসে তোমাদের কল্লাগুলো ধর থেকে আলাদা করে নিই, তাহলে কি মনে করো পুরো স্পেনে এমন একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে— যে এ প্রশ্ন তুলতে দুঃসাহস দেখাবে, আপনি এদের কী জন্য হত্যা করলেন?
– ওরা সবাই অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। বললো, রাহিব হয়ে আছো, বেশ আছো, বাহাদুরি দেখাবার স্বাদ যেন না জাগে। লড়াইয়ের কঠিন ময়দান আর গির্জার ভেতরকার আয়েশী জীবন যাপনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমাণ।
– জীবন সম্পর্কে বোকা পাদ্রী শুনো! যুদ্ধারা মৃত্যুর কোল থেকে সুখ ছিনিয়ে আনে, আর পাদ্রীরা মানুষের সরবরাহকৃত সুখে জীবন চালায়। বীরেরা অস্ত্র চালিয়ে অন্ধকারে আলোর ফুয়ারা বহায়, আর পাদ্রীরা ভোরের আলোয় তাদের আয়েশী বদন বিছায়। যুদ্ধ; সে হচ্ছে ঝড়ো তুফানে টিকে থাকার প্রয়াস, আর রুহবানিয়াত হচ্ছে নিরুদ্বিগ্ন পরিবেশে মেদ আর ভূড়ি বাড়ানোর একটা ফালতু কসরত।
– লোকটা তার কথা আর আগে বাড়াতে পারেনি। মা’আয আর মুনযিররা যেন অনুভব করলেন শালির পাহাড়ের ওদিকে বজ্রপাত হচ্ছে। তারা শুনতে পাচ্ছিলেন লিসাঙ্কু প্রচণ্ড গর্জন দিয়ে বলছেন:
– মুসলমানদের বিরুদ্বে না-পাক উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া ঈসায়ী নামের কলঙ্ক শয়তানরা শুনো! আমি যদি তোমাদের উপর মরুর লুহাওয়ার মতো সর্বধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হই, যদি আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার ন্যায় উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, যদি জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা নিয়ে তোমাদের উপর আছড়ে পড়ি, তাহলে তোমরা কী মনে করবে?
– ওরা আরেকবার সমস্বরে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। বলল: তুমিতো দেখি আমাদের হাতে মারা পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছো। তবে দেখতেই পাচ্ছ সূর্য পশ্চিমাকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে এদিকে কারো আসার সম্ভাবনা নেই। এখানে আমরা আর তুমি ছাড়া মাত্র তিনজন লোক রয়েছে। ওরা আসলে দর্শক। তুমি যদি বাড়াবাড়ি করো তাহলে প্রথমে তোমাকে হত্যা করে তোমার হত্যার স্বাক্ষি হিসেবে ঐ তিনজনকেও হত্যা করে যাব। এরপর এই হত্যার দায় ওয়াদির সেই যুবকদের ঘাড়ে চাপিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য আদায় করেই ছাড়বো।
– মা’আয বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখতেছিল ওদের কথা শুনা মাত্রই পাদ্রী লিসাঙ্কু তাঁর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তিনি এক ঝটকায় তার পাদ্রীয় পোষাক আলখাল্লাটা খুলে একদিকে ছুড়ে মারলেন। ওটা ছুঁড়ে মারতেই শরীরে একজন পুরোদস্তুর সৈনিকের পোষাক বেরিয়ে আসল। মা’আযরা দেখতে পাচ্ছিল তাঁর কোমরে রয়েছে একটা প্রশস্ত বেল্ট। সে বেল্টের সাথে খুব সুন্দর করে বাঁধা একটা চকচকে খাপখোলা তলোয়ার। তলোয়ারের পাশেই রয়েছে কড়া লাল রঙের বাঁট বিশিষ্ট পিলে চমকানো একটা খঞ্জর। মা’আযরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছিল তাঁর পিঠে লটকানো রয়েছে ছোট আকারের মজবুত একটা ঢাল। মা’আযদের হয়রান করে পাদ্রী লিসাঙ্কু যখন তাঁর মাথার পাগড়ীটাও একদিকে ছুঁড়ে মারলেন তখন সেখানে বেরিয়ে এলো উজ্জল ইস্পাতের তৈরি অত্যুজ্জ্বল একটা শিরস্ত্রাণ। সেই স্বচ্ছ শিরস্ত্রাণে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম কিরণ প্রতিফলিত হয়ে পরিবেশটাকে যেন ভয়ঙ্কর বানিয়ে দিচ্ছিল। লিসাঙ্কু শান্তভাবে হাতে তলোয়ার আর ঢাল তুলে নিয়ে সৈনিক চতুষ্ঠয়কে উত্তেজনা দিয়ে বলতে লাগলেন:
– শুনো নিরপরাধ মুসলমানদের শত্রু পাহাড়ী গিদরের দল! আমি তোমাদের চারজনকে একযোগে আমার মোকাবেলায় আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমি দেখতে চাই শয়তানের দোসর তোমরা বিজয়ী হও নাকি মানবতার বার্তাবাহী আমি বিজয়ী হই।
– ওরাও নিজেদের হাতে তলোয়ার উঠিয়ে নিল, তবে লিসাঙ্কুকে সাধারণ একজন পাদ্রী মনে করে ঢাল হাতে তুলার কষ্ট বরদাশত করলো না। তারা মনে করছিল সাধারণ একজন পাদ্রী আমাদের মোকাবেলায় কতক্ষণ আর টিকে থাকবে।
– ওরা পায়ে পায়ে লিসাঙ্কুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
– মা’আয দৃশ্যটা দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে মুনযির বিন যুবাইরকে লক্ষ করে বলল: চাচা! আমাদের মিল্লাতের প্রতি দরদীপ্রাণ এ মহান রাহিব আমাদের পক্ষ নেয়ার অপরাধে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমাদের উচিত তাঁর সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।
– মুনযির তখন মা’আযের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মা’আয এ তাকানোর অর্থ বুঝতে না পেরে সেও তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
– মুনযির বিন যুবাইর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর অত্যন্ত ঘনিষ্ট হয়ে বললেন: বেটি মা’আয! তুমি যদি আমাকে কথা দাও আমি যা বলবো তা তুমি কোথাও প্রকাশ করবে না তাহলে আমি তোমার কাছে একটা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারি।
– মা’আয তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল: চাচা! বলুন কী বলতে চান। আমাকে আপনি অবিশ্বস্ত পাবেন না।
– মুনযির বিন যুবাইর মুচকি হাসলেন। বললেন: বেটি মা’আয! লিসাঙ্কু নামে যে পাদ্রীকে তুমি দেখতে পাচ্ছ আসলে সে কোনো পাদ্রী নয়। সে মূলত পাদ্রী বেশী আমাদের মিল্লাতের গর্বের ধন হাসান ক্রুসু। দেখ মা! ভুলেও কারো কাছে তুমি এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে যাবে না। নতুবা পাদ্রী বেশে হাসান ক্রুসু এ ভূখণ্ডে কওমের যে খেদমত আঞ্জাম দিতে চাইছেন সেটা সম্ভব হবে না।
– মা! দূর অতীতে ফেলে আসা আমার যৌবনের আবেগ যদি সত্য হয়ে থাকে, আমার অনুধাবন শক্তি আমার সাথে প্রতারণা করে না থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি— না দেখলে এবং না চিনলেও তুমি হাসান ক্রুসুকে ভালোবাসো। জীবনে তাকেই আপন করে পেতে চাও। আর সেই বিশ্বাস থেকেই আমি তোমার কাছে রহস্যটা উদ্ঘাটন করলাম। আমার বিশ্বাস তোমার থেকে কখনো এমন কিছু প্রকাশ পাবে না যা হাসান ক্রুসুর মহান কাজের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
– এরপর মুনযির বিন যুবাইর বাসিতের প্রতি তাকিয়ে তাকে লক্ষ করে বলতে লাগলেন: ভাই বাসিত! মিল্লাতের প্রতি তোমার দরদের উপর যদি আমার আস্থা না থাকতো তাহলে অবশ্যই আমি এ রহস্য তোমার উপস্থিতিতে উদ্ঘাটন করতে যেতাম না। আমার ভাই! তোমার প্রতিও আমার বিনম্র আবেদন— কোনো পরিস্থিতিতেই তুমি হাসান ক্রুসুর পরিচয় কাউকে দেবে না।
– মুনযির বিন যুবাইরের কাছ থেকে হাসান ক্রুসুর পরিচয় পেয়ে আনন্দ ও বিস্ময়ের যৌথ ধাক্কায় মা’আয একেবারে হতবাক হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে তখন কোনো কথাই বের হচ্ছিল না।
– সে তখন লড়াইরত হাসান ক্রুসুর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল।
– ইতোমধ্যে চার সৈনিক হাসান ক্রুসুর একেবারে কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। মা’আয এ অবস্থা দেখে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং আল্লাহর দরবারে অশ্রুসজল চোখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আরজি জানাতে লাগলো:
– “আমার মাবুদ! হাসান ক্রুসুকে তোমার নিরাপত্তার কোলে উঠিয়ে নাও! মাবুদ এরাই তো তোমার সেই কাঙ্খিত আদম সন্তান যারা শয়তানের অভিশপ্ত হবার কারণ। এরাই তো সেই ইনসান যাদেরকে সেজদা করার জন্য তুমি ফেরেস্তাকুলকে নির্দেশ দিয়েছিলে। আমার আল্লাহ! নিশ্চয় হাসান ক্রুসুরাই সেই মহান মুজাহিদ যারা কওমের মাথার উপর থেকে অন্ধকারের চাদরটাকে তরবারি আর খঞ্জর দিয়ে কেটে কেটে সেখানে ভোরের সূর্যালোক নিয়ে আসার জন্যে সতত সচেষ্ট। আল্লাহ! তুমি তোমার দ্বীনের এ মহান খাদেমের জীবনের নিরাপত্তার যিম্মাদার হয়ে যাও”!
– মা’আয আর কিছুই বলতে পারছি না। সে কেবল ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল।
– মা’আয সেজদায় লুটিয়ে পড়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল। হঠাৎ আল্লাহু আকবারের বিশাল আওয়াজ শুনে সেজদা থেকে মাথা উঠাল। লড়াইয়ের জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে পেল ওরা ঠিক সৈনিকের কায়দায় হাসান ক্রুসুর উপর আক্রমণ চলাচ্ছে আর হাসান ক্রুসু তেগবাজির শিল্পিত জৌলুষ দেখিয়ে তাদের সে আক্রমণ প্রতিহত করার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে আক্রমণেও চলে আসছেন। মা’আয স্পষ্টতই বুঝতে পারছিল হাসান মূলত এদেরকে নিয়ে খেলছেন। তিনি ওদেরকে আক্রমণের সুযোগ দিয়ে আসলে ওদেরকে ক্লান্ত করে তুলতে চাইছেন।
– মুনযির বিন যুবাইর হাসানক্রুসুর শিল্পিত আক্রমণের প্রশংসা করতে যেয়ে বলতে লাগলেন: বেটি মা’আয! নেকড়ে যতই ছোট আর একাই হোক না কেন ভেড়ার পালকে তাড়া করতে মোটেও ভয় পায় না। শাহিন তার আশিয়ানা থেকে যতই দূরত্বে থাক না কেন গৃধ্রের পাল দেখে মোটেও হতচকায় না। বেটি! তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস তোর সেজদা, হাসান ক্রুসুর জন্য তোর অশ্রুধোয়া দু’আ রঙ না নিয়ে এসে পারে না। এ আমাদের স্বর্ণশাহিন। আমি তোকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি যে চার যুবক তার বিরুদ্ধে লড়ছে অচিরেই ওদের দেহ এখানে টুকরো টুুকরো হয়ে পড়ে থাকবে।
– মা’আয মুনযির বিন যুবাইরের কথার জবাব দিতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় দু’টি বিকট চিৎকার শুনে সে আঁতকে উঠলো। ওদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল হাসান ক্রুসুর মোকাবেলায় লড়ে যাওয়া চার সৈন্যের দু’জনের মাথা একদিকে আর কর্তিত দেহ অপরদিকে পড়ে তড়পাচ্ছে। সাথীদ্বয়ের এ অবস্থা দেখে বাকি দুজনের ভুল ভেঙে গেল। তারা এখন স্পষ্টই অনুভব করতে পারলো আসলে তারা পাদ্রীকে যতটা দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছিল তা ঠিক ছিল না। সুতরাং তারা নিজেদের আত্মরক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠলো। তারা নিজেদের পিঠে লটকে রাখা ঢালটা হাতে তুলতে যাচ্ছিল। হাসান ক্রুসু স্বল্প সময়ের এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একজনের উপর ঈগল-ক্ষিপ্র গতিতে ঝাপিয়ে পড়ে আরেকজনকে জাহান্নামের পথ ধরিয়ে দিলেন। ওদের একমাত্র সাথী ততক্ষণে তার ঢালটা হাতে উঠিয়ে নিয়েছিল। তবে সে হাসান ক্রুসুর ক্ষিপ্রতা এবং সাথীত্রয়ের পরিণতি দেখে লিকলিকে বাঁশের ডগার মতো থরথর করে কাঁপছিল। সে আক্রমণে আসবে দূরের কথা নিজের কম্পমান হাত পা গুলোকেও বশে আনতে পারছিল না। সে যেন সাক্ষাত মৃত্যুকে সামনে দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। হাসান ক্রুসু কতক্ষণ লোকটির প্রতি তাকিয়ে হঠাৎ করে বিদ্যুতের গতিবেগে তার উপর চড়াও হলেন। লোকটা কোনোই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না। অসহায়ের মতো কাটা কলাগাছের ন্যায় দু’টুকরো হয়ে দু দিকে ছড়িয়ে পড়ল।
– হাসান ক্রুসু দ্রুত তলোয়ারে লেগে থাকা রক্ত ওদের জামা দ্বারা পরিষ্কার করত খাপের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর দ্রুতই পাশে ফেলে রাখা পাগড়ি আর রাহিবী পোষাকটা পরে পুরোদস্তুর রাহিব বনে গেলেন।
– মা’আয অপলক তাকিয়ে দেখছিল। তার জন্য তখনও বিস্ময় জমা রাখা ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল পোষাকটা গায়ে চড়িয়েই তিনি নিহত চার সৈনিকের ঘোড়ার দিকে অগ্রসর হলেন। এরপর রেকাবে পা না রেখে ঈগলের মতোই যেন শূন্যে উড়া দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলেন। ঘোড়ায় চড়ে যখন তিনি যখন তার বুকে পদাঘাত হানলেন তখন ঘোড়াটি পাগলের মতো তাদের দিকে দৌড়ে আসতে লাগলো।
– হাসান ক্রসু মা’আযদের পাশে এসে দাঁড়াতেই মা’আয এগিয়ে গিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও শ্রদ্ধাভরা কন্ঠে হাসান ক্রুসুকে লক্ষ করে বলে উঠল: চার সশস্ত্র সৈন্যের বিপরীতে আপনার অবিস্মরণীয় বিজয়কে আমি অন্তর থেকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আপনার বীরত্ব, আপনার সাহস, মিল্লাতের প্রতি আপনার অসীম দরদকে আমি শ্রদ্ধাভরে সালাম জানাচ্ছি। আমি জানতে পেরেছি আপনি আমার ভাই সহ কবিলার আরো তিনজন যুবককে ওদের জুলুমের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তার জন্যও আপনার সীমাহীন শুকরিয়া আদায় করছি। আজ থেকে বেশ কয়েক মাস পূর্বে আমাদের হাবেলিতে আপনার সাথে আমার সাক্ষাত হলে আপনার শানে আমার থেকে ক্ষমাহীন ধৃষ্টতা প্রকাশ পেয়েছিল। আমি আমার সে আচরণের জন্য অনুতপ্ত। আমি সে অপরাধের জন্যও আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
– মা’আয যতক্ষণ কথা বলছিল হাসান ক্রুসু তাঁর দিকে চোরা চোখে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলেন। যখন সে তার কথা বলে নীরব হয়ে গেল তখন হাসান ক্রুসু মাটির দিকে দৃষ্টি অবনত রেখে বলে যেতে লাগলেন: জনাবা! আমার কাছে আপনার ওজরখাহি পেশ করার কোনোই কারণ নেই। আমি এখনও বিশ্বাস করি সে দিন আপনি আমাকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা ছিল কওমের প্রতি আপনার ভালোবাসার দ্ব্যার্থহীন বহিঃপ্রকাশ। আমি সে দিন আপনার আবেগ ঝরা কথা শুনে কুন্ঠিত হইনি, বরং জাতির প্রতি মুহাব্বাত আর জযবা দেখে সে জযবাকে সালাম জানিয়েছি। আমার বিশ্বাস কওমের প্রতি এখনও আপনার মধ্যে সে জযবা ক্রিয়াশীল। আমি সে জযবাকে স্বাগত জানাই। সাধুবাদ জানাই। আর আপনার ভাই সহ কতিপয় যুবকের সাহায্যে এগিয়ে আসার দরুণও শুকরিয়া জ্ঞাপনের কোনো দরকার নেই। কেননা আমাদের মতো রাহিবদের জীবনের ব্রতই হচ্ছে ধর্ম বর্ণ না দেখে মানবতার জন্য কাজ করা। আমি কেবল আমার দায়িত্বটুকুই আঞ্জাম দিয়েছি।
– হাসান ক্রুসু কথাগুলো বলে একটু বিরতী নিলে মা’আয কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই হাসান ক্রুসু মুনযির বিন যুবাইর আর বাসিতকে খেতাব করে কথা বলা শুরু করে দিলে তাকে থেমে যেতে হয়।
– হাসান মুনযির বিন যুবাইরকে লক্ষ করে বলছিলেন— নিহত এ চার যুবকের সাথে গ্রাণাডার সরকারের কোনোই সম্পর্ক নেই। বেশির চেয়ে বেশি কোনো বিদ্বেষ পরায়ণ ইহতেসাবী আদালতের সাথে তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে। এরা কেবল মুসলিম এলাকায় ত্রাস সঞ্চার করে আর্থিক ফায়দা ওঠাতে চায়। আজ ওদের অসৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে গেছে। আমি চলে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে পাশেই কোথাও একটা গর্ত খুঁড়ে ওদের লাশগুলো পুতে রাখবেন। ওদের একটা ঘোড়া আমি নিয়ে যাচ্ছি বাকি তিনটি আপনারা বস্তিতে নিয়ে যাবেন। এগুলো আপনাদের কাজে আসবে। আমি এখন প্রথমে খানকায় যাচ্ছি। ওখান থেকে আমার দাদুকে দেখার জন্য জেলে পল্লীতে যাব। কারণ কাহতানী সরদার কা’ব বিন আমিরের কাছ থেকে জানতে পেরেছি দাদু নাকি খুব বেশি অসুস্থ। তাঁর নাকি বাঁচার আশা নেই। তিনি নাকি আমাকে তাঁর পাশে পেতে আকুল হয়ে আছেন। দাদু যদি আমার সাথে চলে যেতে রাজি হন তাহলে তো ভালো কথা, তা নাহলেও আজই মধ্যরাতে আমাকে সাগরে নেমে যেতে হবে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে হাসান ক্রুসু কোনো প্রকার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই তাঁর ঘোড়াটি খানকাহ অভিমুখে হাঁকিয়ে দিলেন।
– মা’আয তাঁর দীলের ভেতর পোষে রাখা আবেগ আর অনুভূতির দরজা খুলে বসার ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু সে সুযোগ হয়ে উঠেনি। কথাগুলো বলেই হাসান ক্রুসু চলে যাচ্ছিলেন।
– হাসান ক্রুসুর কথা মতো মুনযির বিন যুবাইর আর বাসিত মিলে একটা গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো সেখানে মাটিচাপা দিয়ে দিলেন।
– মুনযির আর বাসিত যখন মৃতদের সৎকারের ব্যবস্থা করছিলেন আর হাসান ক্রুসু ঘোড়ায় চড়ে খানকায় চলে যাচ্ছিলেন, মা’আয তখন ওখানে অনড় থামের মতো দাঁড়িয়ে হাসানের গমণদৃশ্য তাকিয়ে দেখছিল। হাসান যখন খানকার ভেতরে ঢুকে তার দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেলেন তখন সে পাশেই একটা টিলায় দাঁড়িয়ে দীলের আবেগ প্রকাশ করতে পাখির কাতর কন্ঠে গেয়ে উঠল:
– দীলের গহীনে জমানো ছিল অনেক আলাপ
– সারাংশ এটাই— জেনে গেছি আমি নেকাবের আড়ালে থাকা প্রিয় পরিচয়।
– প্রতিটি নিঃসঙ্গ রাতে যিনি ছিল আমার স্বপ্নের সাথী,
– যাকে আমি তালাশ করেছি রোজ রোজ শালিরের উপত্যকায়,
– আমার দীলের কিতাবে সোনালী হরফে লিপিবদ্ধ যার নাম,
– যাকে একসময় মনে করতাম আমার পথের ধুলি,
– কিন্তু ধুলির আড়ালে সে-ই ছিল চির কাঙ্খিত হিরে।
– আমি আজ খুশনসীব সে আজ আমার মনজিলের ইমাম।
– যদিও সে ছিল মরুর এক মায়া মরিচিকা।
– সে বোধহয় দেখিতে চেয়েছে আমার দীলের বেদনার তাপ,
– আজ আমি কেন তাঁকে দীলের ভেতরে দেব না ঠাই।
– আমার নসীবে সম্ভবত লেখা ছিল,
– এভাবেই হবে তাঁর সাথে আমার মোলাকাত।
– মা’আয দীল উজাড় করে গাইছিল আর তাঁর চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু ঝরছিল। সে আনন্দ ব্যথার এমন এক মিশ্র অনুভূতির শিকার হয়ে পড়েছিল যা কেবল অনুভব করা যায়, ভাষার চাদর পরিয়ে তাকে উপস্থাপন করা যায় না।
– মৃতদের সৎকার শেষে মুনযির আর বাসিত মা’আযের পাশে এসে দাঁড়ালে মা’আয মুনযিরকে লক্ষ করে বলল:
– চাচা! আপনিও শুনেছেন হাসান ক্রুসু কিছুক্ষণের মধ্যে উপকুলীয় জেলে পল্লীতে তাঁর দাদুকে দেখতে যাচ্ছেন। চাচা আপনার কাছে তো আমার কিছুই গোপন নেই। আমি হাসানের সাথে সাক্ষাত করতে চাই। এটা কি হতে পারে না আপনি আর আমিও তার দাদুর ওখানে যাই, সেখানে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হোক। তাঁকে বলতে না পারা কয়েকটা কথা বলার চেষ্টা করি?

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল ১৭-১৮ (ক)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...