শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:১০
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ১০ (ক)

সমুদ্র ঈগল ১০ (ক)

কুতায়বা আহসান :

আফ্রিকাস্ত নাসারারা তখন ভীষণ দুশ্চিন্তায়। মুনকিড ভালো করেই জানতো যে তার একার পক্ষে খাইরুদ্দীনের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন শাসককে তার দলে ভিরিয়ে খাইরুদ্দীনের মোকাবেলায় মজবুত একটা শক্তি দাঁড় করাতে মনোযোগী হয়ে উঠে। মুনকিড আফ্রিকার যে শক্তিগুলোকে প্রায় অনায়াসে তার সাথে মিলিয়ে নিতে পেরেছিল তারা ছিল তিলমিসানের শাসক আবু হামু, কুকু‘র অধিপতি ইবনে কাজি, সুগরাবি কবীলার অর্ধেকের নেতা আহমদ বিন কাজি, তিউনিশের শাসক মওলা হাসান। এরা মুনকিডের সাথে একজোট হয়ে বারবারুসার বিপক্ষে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে।

মুনকিড ছিল অত্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষী একজন নেতা। তিলমিসান এবং তিউনিশের শাসকরা জানতো খাইরুদ্দীন বারবারুসা যদি এ এলাকায় তাঁর পা‘ জমিয়ে নিতে পারেন তাহলে অত্র এলাকা তুর্কদের অধীনে চলে যাবে। আর তুর্কদের অধীনে এই এলাকাটা চলে যাক তারা ছিল এর ঘোর বিরোধী।

এ সিদ্ধান্তটা ছিল ঐ মুসলিম নেতাদের চূড়ান্ত একটা অদূরদর্শী ও আহাম্মকির পরিচায়ক। জাতির সাথে গাদ্দারিও বলা যায়। যদি তারা নিজেরাই তুর্কদের বলতেন আপনারা আমাদের হাত শক্তিশালী করুন, আমরা স্পেনীয় মুসলমানদের সহায়তা করবো, তাহলে অবশ্যই তুর্কিরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতো। আর তারা যদি এমনটি করতো তাহলে আজ বোধ হয় স্পেনের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

অন্যদিকে খাইরুদ্দীন বারবারুসাও নীরব বসে থাকেননি। তিনি এবং তাঁর সালাররা তাঁদের শক্তি বাড়িয়ে চলছিলেন। নৌবহরগুলোকেও ঢেলে সাজিয়ে তুলছিলেন। এরপর শত্র“দের উপর চাপ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সুগরাবি কবীলার একাংশের নেতা আব্দুল আজিজ এবং বারবারদের নেতা হাফসিকে তাঁর এখানে আহ্বান করেছিলেন। এরা ছিলেন খাইরুদ্দীনের সমমনা।

খাইরুদ্দীন বারবারুসা একদিন হাসান ক্রুসু, সানআন, সালেহ, কাকাদ, খাজা সারা হাসান আগা এবং তাঁর অন্যান্য সালার সহ তাঁদের নৌবহরে মোতায়েন অস্ত্রপাতির একটা হিসেব নিচ্ছিলেন। ইতোমধ্যে সুগরাবী কবীলার সরদার আব্দুল আজিজ এবং বারবারদের নেতা হাফসী সেখানে এসে পৌঁছান। বারবারুসা তাদেরকে দেখেই উষ্ণ অভিনন্দন জানান। এরপর তাঁদেরকে তাঁর নিজস্ব জাহাজে উঠিয়ে নেন। সেখানে নেতৃস্থানীয় সবাই যার যার আসনে বসে গেলে সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন মিল্লাতের প্রতি অন্তপ্রাণ সুগরাবি কবীলার সরদার আব্দুল আজিজ। তিনি বারবারুসাকে খেতাব করে বলছিলেন:
বারবারুসা! আমার প্রিয়তম ভাই! প্রথমেই আমি আফ্রিকায় আপনার এককালের অধীনস্ত এলাকা মুক্ত করণের উপর অভিনন্দন জানাচ্ছি।

এরসাথে আমি কিছু আশংকাও তুলে ধরছি। যদিও আমাদের জন্য সবচেয়ে খুশির ব্যাপার হচ্ছে আপনি আপনার অধীনস্ত এলাকা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন। কিন্তু এখানকার হিস্পানীয় নেতা মুনকিড আপনাকে শান্তিতে থাকবে দিবে বলে মনে হচ্ছে না। আমার জানা মতে সে ইতোমধ্যেই আপনার বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে দিয়েছে সে আফ্রিকায় আমাদের মুসলমানদের মধ্যকার গাদ্দার নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছে। আমার ধারণা- সে অচিরেই আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। আমি আর হাফসি আপনার এই কৃতিত্বে খুবই আনন্দিত যে, আপনি তাদের শক্তিকেন্দ্র পানুনে আক্রমণ করে আপনার সামরিক শক্তি অনেকখানি বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। আমরা আপনাকে অন্তর থেকে এ জন্যেও অভিনন্দন জানাই- আপনি শুধু পানুন নয় একই রাতের ভেতর মুনকিডের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার এলাকায়ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। এখন আমাদের পরামর্শ হলো আপনি আফ্রিকায় আপনার শক্তিকে ঠিক সেভাবে মজবুত করে গড়ে তুলুন যেভাবে সাগরের প্রচণ্ড ঢেউ পাকা দেয়ালে আঘাত খেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

এ পর্যন্ত বলার পর আব্দুল আজীজ বারবারুসার দিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তাকিয়ে পুনরায় বলতে লাগলেন:
আমার প্রিয়তম ভাই! আমার আর হাফসির ব্যাপারে আপনি আশ্বস্থ থাকুন, যখনই শত্র“ আপনার উপর হামলা চালাতে আসবে তার আগেই আমি আর হাফসি নিজ নিজ সৈন্য নিয়ে আপনার কাছে পৌঁছে যাব। আমরা চাই এই সরজমীন থেকে হিস্পানীয়দের বিদায় করে এখানে তুর্কদের শক্তিকে মজবুত করে তুলতে।
হিস্পানীয়রা আমাদের মুসলিম ভাইদের সেখান থেকে বের করে দিয়েছে। যদি এরা আফ্রিকায়ও দখলদারিত্ব স্থায়ী করে নিতে পারি তাহলে আমি মনে করি মুল্লাতে মুসলিমার জন্য এরচেয়ে বড় বদবখতি আর কিছু হতে পারে না।

আমার কবীলার অবস্থা হচ্ছে- আমরা দ্বিধাবিভক্ত। আমার কবীলার আরেক সরদার আহমদ বিন কাজী বিভিন্ন লোভ লালসা দেখিয়ে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস অচিরেই আমি আমার কবীলাকে একই সূত্রে গেঁথে নিতে পারবো।

এই মুহূর্তে আমি আর হাফসি আপনাকে একীন দিয়ে বলতে পারি- আমার ভাই! আফ্রিকায় আপনি নিজেকে একা মনে করবেন না। আমরা আপনার সাথে আছি। অবস্থা ভালোই থাক কিংবা খারাপ কোনো অবস্থায়ই আমরা আপনাকে একা ছেড়ে চলে যাব না। আপনার সব বিপদে আমরা বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাব। আমরা আপনার সকল শত্র“র চোখে চোখ রেখে কথা বলবো।

আব্দুল আজিজের এ কথাগুলো শুনে খাইরুদ্দীন এবং তাঁর সালাররা উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন। খাইরুদ্দীনের চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি তখন আব্দুল আজিজের পিঠ চাপড়িয়ে বলতে লাগলেন:
আব্দুল আজিজ আমার ভাই! আমার জীবনের মাকসাদই হচ্ছে হিস্পানীয়দেরকে আফ্রিকা থেকে বিতাড়ন করা।

খাইরুদ্দীন এ পর্যন্ত বলতেই বারবারদের নেতা হাফসি বলে উঠলেন:
বারবারুসা! আমার ভাই! আরেকটি শঙ্কা আমাদের মাথার উপর চক্কর কাটছে। মুনকিডের নেতৃত্বে যে যৌথবাহিনী গড়ে উঠছে তাদেরকে পরাজিত করে মুনকিডদের আফ্রিকা থেকে তাড়িয়ে দিলেও সে শঙ্কাটা থেকে যাবে। সেই শঙ্কা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে বলে আমি মনে করি।

খাইরুদ্দীন হাফসির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন:
আমার মুহতারাম ভাই আপনি কোন শংকার কথা বলতে চাইছেন?

বারবারদের নেতা কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন:
“খাইরুদ্দীন! আমার প্রিয়তম ভাই! আমরা একজোট হয়ে মুনকিড ও তার যৌথবাহিনীকে পরাজিত করে যদি হিস্পানীয়দের এখান থেকে তাড়িয়েও দেই তবুও যে বিরাট শঙ্কাটি থেকে যাবে সেটা হচ্ছে- সাগরে হিস্পানীয় সম্রাট চার্লস-এর যে বিশাল শক্তি রয়েছে তারা নিশ্চয় নীরব থাকবে না। নিশ্চয় তারা তখন সক্রিয় হয়ে উঠবে। তা-ই যদি হয় তাহলে আমরা কি তাদের মোকাবেলায় ঠিকে থাকতে পারবো? আমরা কি সেই শক্তিপ্লাবনের বিপরীতে কামিয়াব হতে পারবো?

এ পর্যন্ত বলে বারবারদের নেতা হাফসি একটু বিরতী নিলেন, এরপর কথার ধারা অব্যাহত রেখে বলতে লাগলেন:
বারবারুসা! আপনিও জানেন, আমরাও জানি আমাদের তুর্কশক্তির কাছে এখন হিস্পানীয়দের মতো বিশালাকারের কোনো নৌশক্তি নেই। তাই আমার প্রস্তাব হলো আমরা যে সিদ্ধান্তই নিই না কেন আমাদেরকে খুব ভেবে চিন্তেই অগ্রসর হতে হবে। তারপরও আমি আপনকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই আপনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন সর্বাবস্থায় আমাকে আপনার পাশে পাবেন। হিস্পানীয়দের বিতাড়নের জন্য আমার সব শক্তি নিঃশেষ করে দিতেও মোটেও কুন্ঠিত হবো না।

চার্লস সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি সে অত্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষী। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে সে যখন সিংহাসনে আরোহণ করে তখন শপথ করেছিল- কাউকে সে তার ধর্মত্যাগে বাধ্য করবে না। কিন্তু রোমের পোপ তাকে সেই শপথ থেকে মুক্ত ঘোষণা করার পর থেকে সে তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে হিস্পানীয় মুসলমানদের সাথে রাণী ইসাবেলার মতোই আচরণ করছে। সে সেখানে অত্যাচারের আগুন জ্বালিয়ে রাখছে। হাফসি তাঁর কথা বলে নীরব হয়ে গেলে বারবারুসা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলেন:
মুহতারাম হাফসি! আপনি যা বলছেন আমি তার সাথেএকমত। আমরা হিস্পানীয়দের সকল শক্তির সাথে মোকাবেলা করে যাব। আমি আপনাদেরকে এ ব্যাপারে জানিয়ে রাখছি- হিস্পানীয় সম্রাট চার্লস যদি তাদের পুরো নৌশক্তিকে আমাদের মোকাবেলায় নিয়ে আসে তবুও আমরা পিছিয়ে না গিয়ে বুক টান করে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যাব।

শত্র“র উপর হামলা চালাবার জন্যে আমরা যে রূপরেখা এঁকে রেখেছি তা কতকটা এই রূপ- বর্তমানে আফ্রিকায় হিস্পানীয়দের যে শক্তি রয়েছে আমরা তাদের দিকে আপাতত নজর দেব না। আমরা সর্বপ্রথম তিউনিশের শাসক মওলা হাসানের উপর আক্রমণ চালাবো। কেননা গাদ্দারদের মধ্যে হাসানই হচ্ছে সর্বাধিক বেশি সক্রিয়। আমরা যদি তার অধীনস্ত এলাকা দখল করে নিতে পারি তাহলে না শুধু আমাদের সেনাসংখ্যা বাড়বে, বরং এক বিস্তৃত ভূখণ্ড আমাদের অধীনে চলে আসবে। আমরা তখন জলে এবং স্থলে আমাদের শক্তি বাড়িয়ে তুলতে পারবো। সর্বোপরি আমাদের নৌবহরগুলোকে নিরাপদ রাখার মতো বন্দর পেয়ে যাব।

বারবারুসার এই সিদ্ধান্তের সাথে আব্দুল আজিজ এবং হাফসি কেউই ভিন্নমত পোষণ করেননি। এরপর তারা তিনজন মিলে অত্যন্ত গোপনে তিউনিশ আক্রমণের রূপরেখাটা চূড়ান্তকরণে মনোনিবেশ করেন।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল ৮-৯

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...