বুধবার, ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৯:০৯
Home / আকাবির-আসলাফ / ভারতের দুই মাদানী; বিভক্তির সীমারেখা!

ভারতের দুই মাদানী; বিভক্তির সীমারেখা!

মুহাম্মাদ নাজমুল ইসলাম :

দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টা নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করি। দারুল উলূম আসার পর থেকে অনেক উস্তাদ বন্ধুবান্ধব বার বার তাকিদ দিয়ে বলেছিলেন বিষয়টি ভালো করে তাহকীক করে জানানোর জন্য। বিষয়টি স্বচ্ছভাবে নিখুঁত উপস্থাপনের জন্য দারুল উলূমের বিভিন্ন উস্তাদ ছাত্রের সাথেও আলাপ করি। মাশাআল্লাহ এরই ভিতরে বন্ধপ্রতিম “হাওলাদার জহীরুল ইসলাম” বিষয়টি নিয়ে সুন্দর একটা রিপোর্ট তৈরি করেন তাতেও অনেক তত্ত্ব পেয়ে যাই। সবমিলিয়ে যা জানলাম সবার জ্ঞাতার্থে দায়িত্ব মনে করে উভয় মাদানীর বিভক্তির সীমারেখা জানিয়ে দিতেই এ প্রয়াস….

আমরা জানি ভারত উপমহাদেশে ব্যবসার নামে দখলদার বৃটিশদের বিতাড়িত করার পর শাহ ওয়ালীউল্লাহি চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রাহ.’র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় মুসলমানদের সবচে’ পুরনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’।

যে সংগঠনটিরই একান্ত সহযোগী ও সর্পরাজ ছিলেন শায়খুল আরব ওয়াল আজম হজরত সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.৷ উক্ত সংগঠনটি ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐতিহাসিক অবদান রাখে৷ স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় মুসলমানদের যে কোনো সংকটে (ধর্মীয় বা সামাজিক) জমিয়ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে৷যা আজও বিধ্যমান।

আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ৯৯ বছর পর্যন্ত নেতৃত্বের পরিবর্তন আসলেও দলটির মাঝে কোনো বিভক্তি বা ফাটল অদৌ দেখা হয়নি৷ কিন্তু ২০০৮ সালে এসে শত বছরের ঐক্যের বন্ধনে চিড় ধরে৷ তখনকার জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রেসিডেন্ট মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানি ও সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানি’র চিন্তায় পার্থক্য দেখা দেয়৷ দু’জনের দর্শন দু’দিকে মোড় নিতে থাকে৷না শেষ পর্যন্ত জমিয়তটি দুটি গ্রুপেই বিভক্ত হয়ে যায়৷ দেশের উলামা-তুলাবাও দু’গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়৷ এক্ষেত্রে আমজনতা অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন।

উভয় জমিয়তই ইসলাম, দেশ ও মানবতার জন্য কাজ করে যায় দাপটের সাথে৷ এরই মাঝে ২০১৫ সালের এসে রমজানে ভারতীয় মুসলমানগণ একটি খুশির সংবাদ শুনতে পান৷ জানা যায় ‘উভয় জমিয়ত নাকি নিজেদের চিন্তার পার্থক্য ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির জন্য এক সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্তে উপনিত হতে যাচ্ছে৷’ ঈদের পর দিল্লির হেডঅফিসে জমিয়তের (দু’দলেরই) নেতৃবৃন্দ গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হন৷ পরস্পরের মতপার্থক্যের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন৷ তবে কর্ম-কৌশল নির্ধারণে কিছুটা মতপার্থক্য রয়ে যায়৷ ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে এভাবে-

১. দুই জমিয়তের নেতৃবৃন্দ নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন;
২. সাধারণ কার্যক্রম চলবে এককভাবে৷

৩. নিজ দলের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সবাই স্বাধীন থাকবে;
৪. দেশ-জাতির কল্যাণে সবাই এক সাথে কাজ করবে;
৫. জাতীয় কোনো ইস্যুতে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না;
৬. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে সবাই অংশ গ্রহণ করবে;
৭. সর্বক্ষেত্রে একে অন্যের সহযোগিতা করবে৷

মুদ্দাকথা হলো, বাহ্যত জমিয়ত দুই হলেও বাস্তবে এক৷ তাদের মাঝে কার্যত কোনোই বিরোধই অবশিষ্ট থাকবে না৷ এ তো ছিলো জমিয়তের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস৷ তবে আমরা যে বিষয়টি  ফোকাস করতে চাই তা হলো, জমিয়ত নেতৃদ্বয়, মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানি ও সেক্রেটারি জেনারেল, মাওলানা মাহমুদ আসআদ মাদানি’র পারস্পরিক সম্পর্কটা কেমন? তারা কি আসলেই বিভক্ত? ব্যক্তি পর্যায়ে একে অন্যকে কতোটা মুহাব্বত করেন৷ তো চলুন সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক৷

অনেকেই মনে করেন দুই মাদানি’র পরস্পরের সম্পর্কটা ভালো নয়৷ পরস্পরের মাঝে দূরত্ব অনেক৷ মজার ব্যাপার হলো, তাদের বিরোধে(!)র বিষয়টি বাংলাদেশের জমিয়ত পর্যন্ত গড়িয়েছে৷ সেখানেও কিছুটা সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে৷ (আরো একটু বাড়িয়ে বলতে গেলে বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেমন না কথার কথা ‘সাপ নেউলে ঘেঁষাঘেঁষি’) অথচ এখানের বাস্তব চিত্রটা কিন্তু একেবারেই ভিন্ন৷ তাদের পারিবারিক বন্ধন কতোটা মজবুত একে অন্যের কতোটা কাছের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে৷

১৷ আরশাদ মাদানিকে বর্তমান ‘মাদানি খানদানে’র অভিভাবক নির্ধারণ৷ কিছুদিন আগে মাওলানা মাহমুদ মাদানি দিল্লির জমিয়ত অফিসে এক আলেমের প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন, ‘মাদানি পরিবারে বহু আগ থেকেই একটি নিয়ম আছে, পুরো খান্দানের একজন মুরুব্বি বা অভিভাবক থাকেন৷ বর্তমানে আমরা সবাই মিলে আমার শ্রদ্ধেয় চাচা মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানিকে আমাদের পারিবারিক অভিভাবক নির্ধারণ করেছি৷ কর্মক্ষেত্রে কৌশলগত ও কাঠামোগত দিক থেকে পরস্পরের কিছুটা দ্বিমত থাকতে পারে৷ এটা স্বাভাবিক৷ এটাকে ব্যক্তিপর্যায়ে টেনে আনা উচিত নয়৷’

২৷ মাহমুদ মাদানির ছেলের বিয়ে পড়িয়েছেন আরশাদ মাদানি৷ গত দু’বছর আগে মাওলানা মাহমুদ মাদানি’র ছেলে ‘হুসাইন মাদানি’র বিয়ে হয়৷ ওই বিয়ের মুরব্বি ছিলেন মাওলানা সাইয়্যিদ আরশাদ মাদানি৷ এমনকি স্বয়ং আরশাদ মাদানি ওই বিয়ের খুৎবা পাঠ করেন৷

৩৷ গত বছর ১২ মার্চ দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জমিয়তের ‘জাতীয় ঐক্য সম্মেলনে’ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানি মাওলানা মাহমুদ মাদানি’র হাত ধরে নিয়ে মঞ্চে আরোহণ করেন৷ তখন ওই সম্মেলনস্থলের লক্ষ লক্ষ জনতা তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন৷ সবাই নিজেদের শুধরে নেবার চেষ্টা করেন৷ জাতীয় দুু’নেতার এমন হৃদ্যতা থেকে ঐক্যের শিক্ষা গ্রহণ করেন৷ এতো দিন তাদের পারিবারিক মুহাব্বত-ভক্তি জনতা দেখতে না পেলেও ওই দিন দেখার সুযোগ পায়৷

৪৷ মাহমুদ মাদানির বাসভবনের খাদেমের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, যখনই মাহমুদ মাদানি দেওবন্দে আসেন চাচার (আরশাদ মাদানি) সাথে দেখা করতে যান৷ তার বাসায় একসঙ্গে খানায় শরিক হন৷ তার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর নেন৷ এছাড়া বছরে দু’একবার পারিবারিক ভোজের আয়োজন করা হয়৷ তখনও সবাই আনন্দের সাথে এক দস্তরখানে মিলিত হন৷ দেওবন্দে ৪/৫ বছর ধরে আছেন এবং মাদানি পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন ক’জন ছাত্রও ওপরের বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করলেন৷

তারা আরো জানালেন, ঈদের সময় উভয় হজরত একসঙ্গে নামাজ আদায় করে বাসায় ফেরেন৷ পরস্পরের বাসায় মিষ্টান্ন হাদিয়া পাঠান৷ দুপুরে একই দস্তরখানে খাবার গ্রহণ করেন৷ এমন উদারহণ ভুরি ভুরি দেয়া যাবে৷ অথচ বাংলাদেশি রাজনীতিকদের মধ্যে এ ধরনের চিন্তা কল্পনাও আনা অসম্ভব।

বড়রা আসলেই ‘বড়’ হন৷ এই তো হো তাদের আদর্শিক পরিচয়৷ কর্মক্ষেত্রে কৌশলগত দ্বিমত থাকলেও ব্যক্তিপর্যায়ে নেই সামান্যতম দূরত্ব৷ এটাই তো নববি আদর্শ৷ এটাই খোলাফায়ে রাশেদিনের চরিত্র৷ তারা তো সে আদর্শ ও চরিত্রের বাহক৷ তাদের শরীরে যে প্রবাহিত হয় নবি বংশের রক্তধারা! এখান থেকেই আমরা শিখতে পারি৷ ভুলে যেতে পারি নিজেদের ছোট-খাটো দ্বন্দ্ব৷ নিতে পারি ঐক্যে।

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল ‍উলুম দেওবন্দ

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...